আমি, কলিম।
তুমি! এতো রাতে এই দোতলার ছাতে এলে কি করে?
পাইপ বেয়ে উঠেছি।
পাইপ বেয়ে! পড়ে গেলে কি দশা হতো ভেবেছো একবার?
এখন আমি মরতে ভয় পাই না রীণা।
বুঝলাম মস্ত বীর পুরুষ তুমি। এখন আবার আমাকে নিয়ে ছাতের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে চাইবে না তো?
ঠাট্টা নয় রীণা। আমি তোমার শেষ কথা শুনতে এসেছি। চলো, আমরা এখন থেকে পালিয়ে যাই। দূরে, কোনও দূর দেশে গিয়ে ঘর বাঁধবো আমরা।
রীণার একটা কোমল হাত তুলে নেয় কলিম তার হাতে।
আব্বাজানকে তো তুমি জানো। এরপরেও তুমি এ কথা কি করে বলছে কলিম আমাকে তুমি ক্ষমা করো।
আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। যদি তুমি আমার মৃত্যু কামনা করো, বলো আমি ফিরে যাচ্ছি, আর কখনও আসবো না।
ছিঃ! এ কথা বলো না। তুমি কৃতী ছাত্র, বিলেত যাচ্ছো, ফিরে এসে নিশ্চয়ই কোনও সুন্দরীকে বিয়ে করে সুখী হবে তুমি। ততদিনে আমার স্মৃতি মুছে যাবে তোমার মন থেকে। ভুলে যাবে তুমি রীণা চৌধুরী একদিন তোমায় ভালবেলেছিল–সমস্ত হৃদয় উজাড় করে দিয়ে। এ কয়দিন অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আত্মহত্যা করবার সাহস আমার নেই, পারিনি। এই বন্দীশালার দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে আমি পাগল হয়ে যাবো কলিম!
গলাটা ভেঙে এলো রীণার। টপটপ করে কয়েক কোঁটা তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়লো কলিমের হাতের ওপর।
কেঁদো না লক্ষ্মী! এখনো সময় আছে। চলো এ অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে আমাদের প্রেমের অপমান হবে রীণা।
কিন্তু আমি যে দুর্বল। অবিবাহিতা তরুণীর সমস্ত দ্বিধা, সমস্ত দ্বন্দ্ব যে আমার পা জড়িয়ে ধরেছে।
আমি কথা দিচ্ছি রীণা, কালই আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করে ফেলবো ম্যারেজ রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে, এবং তার আগে পর্যন্ত তোমাকে আমি স্পর্শ করবো না। আমাকে বিশ্বাস করো রীণা।
বেশ, প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষার ভার তোমার ওপরেই থাকলো। আমি এই সুন্দর চাঁদ আর ঐ মাতাল হাওয়াকে সাক্ষী রেখে তোমার হাতে নিজকে সমর্পণ করলাম।
পা টিপে টিপে দুজনে এসে দাঁড়ালো বিরাট জমিদার বাড়িটার পেছনের দিককার পাঁচিলের সামনে। ওপারে জংলা মতো একটা মাঠ আছে আবর্জনায় ভর্তি। সেটা পেরোলেই নিরাপদে রাস্তায় এসে পড়তে সুবিধে হয় না।
ঝুপ করে পাঁচিলের ওপর থেকে দুজনে একসাথে লাফিয়ে পড়লো মাটিতে। অমনি ভোজবাজীর মতো জনা ছয়েক ঘণ্ডামার্কা লোক ঘিরে ধরলো ওদের। প্রস্তুত হওয়ার আগেই প্রচণ্ড মুষ্টাঘাত এসে পড়লো কলিমের নাকের ওপর। চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো কলিম। আরও কয়েকটা আঘাত এসে পড়লো ওর মাথায়, ঘাড়ে পিঠে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো সে।
এদিকে অপর একজন রীণার মুখ চেপে ধরলো একটা রুমাল দিয়ে। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধে মাথাটা ঝিমিয়ে এলো রীণার। অল্প কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করে অজ্ঞান হয়ে পড়লো সে-ও।
দুজনে পাঁজাকোলা করে রীণার সংজ্ঞাহীন দেহটা নিয়ে একটা গাড়িতে তুললো। দুমিনিটের মধ্যেই আশেপাশে আর কারো চিহ্নমাত্র থাকলো না। কলিম কেবল পড়ে রইলো ঝোঁপঝাড়ের পাশে অজ্ঞান অবস্থায়।
.
০৬.
পরদিন একমাথা উস্কোখুস্কো চুল আর শুকনো মুখে চৌধুরী সাহেব এসে উপস্থিত হলেন শহীদের বাসায়।
আমাকে বাঁচান মি. শহীদ।
কি হলো? নতুন কোনও খবর আছে?
রীণাকে পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাত থেকে। আজ একটু আগে একটা চিঠি পেলাম। এই দেখুন।
হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলো শহীদ। তাতে লেখা:
মি. চৌধুরী,
যে সামান্য শাস্তির কথা গত চিঠিতে লিখেছিলাম,
আজ নিশ্চয়ই তা টের পেয়েছেন। রীণাকে নিয়ে গেলাম।
আজ রাত এগারোটায় চাবিটা নিয়ে রেস কোর্সে আসবেন। সেখানে আমার লোক আপনার জন্যে অপেক্ষা করবে।
চাবিটা হাতে পেলে রীণাকে অক্ষত অবস্থায় আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবো। কিন্তু যদি আবার পুলিসের কাছে যান তাহলে আপনার বংশ গৌরব আমি ধুলোয় মিশিয়ে দেবো। ধর্ষিতা রীণার উলঙ্গ দেহ পড়ে থাকবে রাস্তার ধারে। পত্রিকা মারফত এ খবর পৌঁছবে প্রতিটি ঘরে প্রতিটি লোকের কানে। আমার কথার নড়চড় হবে না, তার প্রমাণ পেয়েছেন। এই কথারও নড়চড় হবে না। অতএব সাবধান!
নেসার
চিঠিটা পড়ে বিস্মিত শহীদ জিজ্ঞেস করলো, এ চিঠিটা পাওয়ার পরও আমার কাছে এসেছেন! ধন্য আপনার সাহস!
ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম, তাই আপনার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি মি. শহীদ। এতো সাহস আমার নেই, আমি বড় দুর্বল। সেদিন অতো লোকের মধ্যে কথাটা আপনাকে বলতে পারিনি। যে চাবির জন্যে এতো কিছু, সে চাবি আমার কাছে নেই।
নারায়ণগঞ্জে আছে তো…
না। সেখানেও নেই। বাবা আমাকে সে চাবি দিয়ে যাননি।
আশ্চর্য তো! যাহোক, সে কথা পরিষ্কার করে জানাননি কেন প্রথম রাতেই!
জানাতে পারিনি। আত্মসম্মানে লেগেছে। মিথ্যা অহমিকার মোহজালে আবদ্ধ ছিলাম আমি। গত রাত্রে আমার সে ভুল ভেঙেছে। তার আগেই আমি আমার সর্বনাশ করে বসেছি।
আপনার বাবা সে চাবি আপনাকে দেননি কেন? তাঁর একমাত্র সন্তান হিসেবে ওটা তো আপনারই পাবার কথা?
কেন যে দেননি তা কারো কাছে ভেঙে বলা যাবে না মি. শহীদ। ও প্রশ্ন থাক।
তাহলে ব্যাপার দাঁড়ালো এই যে, চাবিটা আপনার কাছে নেই, অথচ সে চাবি আজ রাত এগারোটার মধ্যে আপনি নেসার আহমেদকে না দিলে আপনার মেয়ের সর্বনাশ করবে সে।