শহীদ বললো, আপনার ঘরে আমাদের এখনই একবার নিয়ে যেতে হবে, মি. চৌধুরী।
নিশ্চয়ই। চলুন, গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
সবাই বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। আনিস চৌধুরী ড্রাইভিং সীটের দরজাটা খুলেই
কি ব্যাপার, কি হলো?সবাই অবাক হয়ে এগিয়ে গেল।
সাপ। সীটের ওপর সাপ।
সবাই কাছে গিয়ে দেখলো একটা গোখরা সাপ ফণা তুলে বসে আছে। লক লক করে তার জিভটা এক একবার বেরিয়ে আসছে। লাল সূতা দিয়ে ওটার ফণার কাছে একটা ভাঁজ করা কাগজ বাঁধা। কাগজটা সরিয়ে ফেলতে পারছে না বলে সাপটা উত্তরোত্তর উত্তেজিত হয়ে উঠছে।
রিভলভারটা বের করে গুলি করলো শহীদ। বিষধর গোখরার ফণাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ততক্ষণে একজন সেপাই এসে উপস্থিত হয়েছে। লাঠি দিয়ে সে মরা সাপটা বের করে রাস্তায় ফেললো। ভাঁজ করা কাগজটা খুলে দেখা গেল একটা চিঠি। তাতে লেখাঃ
চৌধুরী সাহেব,
আমার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা নেই দেখছি। আমি বিষধর গোক্ষুর। আমি করতে পারি না এমন কাজ নেই! আপনি আমার আদেশ অমান্য করে পুলিসের সাহায্য গ্রহণ করতে চলেছেন। এজন্যে আপনার জন্যে সামান্য শাস্তির আয়োজন করছি। দুএক দিনেই সেটা হাতে নাতে টের পাবেন। কিন্তু তবু আপনাকে আরেকবার সুযোগ দেবো ভাবছি। এবং সেটাই শেষ সুযোগ। তারপরও যদি আপনি পুলিস বা শহীদ খানের মতো চুনোপুটি টিকটিকির সাহায্য গ্রহণ করেন তবে আপনার কন্যার ইজ্জত নষ্ট করতে দ্বিধামাত্র করবো না। এই আমার শেষ কথা।
নেসার
চিঠিটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে অসহায় দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে একবার চাইলেন চৌধুরী সাহেব। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মনের উদ্বেগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তাঁর চোখে–মুখে।
শহীদ তাড়া দিলো,কই, চলুন মি. চৌধুরী!
ও, শ্যা, এই যে চলুন।
.
০৫.
রাত দশটার সময় মিঃ চৌধুরীর ড্রইংরূমে দুটো ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে একজন খোঁড়া লোক এসে দাঁড়ালো। তার দীর্ঘ-ছায়া গিয়ে পড়লো মিঃ চৌধুরীর কোলে খুলে রাখা একটা ইংরেজী বই-এর উপর।
আসুন মি. শহীদ, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। বলে বইটা বন্ধ করে আগন্তুকের মুখের দিকে চেয়েই চমকে উঠলেন চৌধুরী সাহেব। আতঙ্কিত হয়ে বললেন, আপনি কে? কি চান?
পরিচয় দিচ্ছি। তার আগে বসতে বলুন।
সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করে চৌধুরী সাহেব বললেন, বসুন।
আমাকে দেখে ভয় পাবার কিছুই নেই, মি. চৌধুরী।
আমি আপনার গুপ্তকক্ষের চাবি দাবি করতে আসিনি। কারণ আমি জানি আপনার বাবা সে চাবি আপনাকে দিয়ে যাননি। আমি বোকা নেসার নই। আমাকে দেখে আতঙ্কিত হবেন না; দেখতেই পাচ্ছেন, ল্যাংড়া মানুষ, কতটুকুই বা আমার ক্ষমতা। আপনার কোনও ক্ষতিই আমি করতে আসিনি। আপনি নিশ্চিত হয়ে আমার বক্তব্য শুনতে পারেন।
সব খবরই রাখেন দেখছি। যাক, আপনার বক্তব্যটা শুনি?
আমার সময় কম। সংক্ষেপে সব কথা সেরে সরে পড়তে চাই। কলিমের সাথে আপনার মেয়ে রীণার বিয়েতে আপনার অমত কেন?
তার আগে আমি জানতে পারি কি আপনি প্রশ্ন করবার কে?
আমার পরিচয় শুনলে আঁতকে উঠবেন-তাই পরিচয়টা গোপন রাখছি। আপনার ভালোর জন্যেই বলছি। এ বিয়েতে অমত করে ঠিক করেননি।
ভালো মন্দ বুঝবার ক্ষমতা আমার আছে। চাষার ছেলের সাথে চৌধুরী বংশের
এ বিয়েতে আপনার বংশের সম্মান কমে যাবে, আর নেসার আহমেদ যদি আপনার মেয়েকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে সম্মান বাড়বে, এই বলতে চান?
আমি আপনাকে কিছুই বলতে চাই না, আপনি এখন যেতে পারেন।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো খোঁড়া লোকটা উত্তেজিত হয়ে, তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, বংশের ইজ্জত! ছিঃ লজ্জা করে না খোলশ মুখে পরে সমাজে বংশের বড়াই করে বেড়াতে? আপনার কাপুরুষ পিতা বংশের ইজ্জতের ভয়ে সমস্ত ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন পুরুষত্বহীন। প্রজনন ক্ষমতা তাঁর ছিলো না। জানতে পারি কি, তবু আপনার জন্ম সম্ভব হয়েছিল কি করে? একজন সাধারণ চাষাভুষো চাকরের ঔরসে নয় কি?
খবরদার! মুখ সামলে কথা বলো!–চিৎকার করে উঠলেন চৌধুরী সাহেব।
সত্যি কথা মুখের ওপর বলে যাচ্ছি। আপনার নিজের জন্ম ইতিহাস আপনার অজানা নেই। তবু সমাজের মাথায় বসে মিথ্যা বংশ গরিমার অহমিকায় বেলুনের মতো ফুলে থেকে যদি নিজে সুখী হতে চান আমার আপত্তির কিছুই ছিলো না। কিন্তু দুটি জীবন নষ্ট করে দেবার কোনও অধিকার আপনার নেই।
get out! বেরিয়ে যাও তুমি এখান থেকে।
যাচ্ছি। তার আগে আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, এ বিয়ে হতেই হবে-কেউ ঠেকাতে পারবে না। আপনার এই মিথ্যে বংশ গরিমার চাইতে অনেক বড় অনেক মহান হচ্ছে দুটি তরুণ তরুণীর নিষ্পাপ প্রেম। এই প্রেমকে সফল করতে আমি আমার প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেবো প্রয়োজন হলে।
দুই কান দুহাতে চেপে ধরলেন চৌধুরী সাহেব। থর থর করে সর্বশরীর কাঁপছে তীর। চোখের সামনে দেখলেন দুটো ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অকুতোভয় খোঁড়া লোকটা।
.
আবছা চাঁদের আলোয় রাতটা বড় সুন্দর। সেই সাথে দমকা পুবের হাওয়া মস্ত বড় বড় সাদা মেঘের টুকরোগুলোকে অনায়াসে উড়িয়ে নিয়ে চলেছে কোন নিরুদ্দেশে। মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে মেঘে পূর্ণিমার চাঁদ। আবার হঠাৎ ফিক করে হেসে উঠছে। রাত সাড়ে দশটা। এমন সময়, কে? চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলো রীণা।