কামালের দিকে চেয়ে একটু ইতস্ততঃ করলেন বিখ্যাত বনেদী জমিদার আনিস চৌধুরী। শহীদ বললো, ও হচ্ছে কামাল আহমেদ, আমার বন্ধু এবং সহকর্মী। ওর সামনে আপনি সব কথা বলতে পারেন।
সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে খুলে বলছি-একটু ধৈর্য ধরে শুনুন দয়া করে।
কাল মাঝরাতে আমার ঘরের মধ্যে কোনও অপরিচিত মানুষের চলাফেরার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে যায়। চেয়ে দেখলাম ছায়ার মতো কে একজন আমার ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বালিশের তলায় হাত দিয়ে আমার রিভলভারটা পেলাম না। ভাবছি চিৎকার করে লোক ডাকবো কিনা। এমন সময় মূর্তিটা আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো এবং মৃদুস্বরে বললো, খবরদার, কোনও রকম চিৎকারের চেষ্টা করবেন না। আপনার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক এবং তার রিভলভারের নল আপনার দিকেই । চেয়ে আছে। এতে সাইলেন্সর লাগানো আছে নিঃশব্দে আপনাকে পরপারে চলে যেতে হবে একটু নড়াচড়া বা চিৎকার করলে।
টুঁ শব্দটি না করে বিছানায় পড়ে থাকলাম। মূর্তিটা একটা টর্চ জ্বালিয়ে সারা ঘরের দেয়ালে তন্ন তন্ন করে কিছুক্ষণ ধরে কি যেন খুঁজলো। ঘরের মধ্যে যে গুপ্ত দেয়াল সিন্দুকটা আছে পরিবারের দু একজন ছাড়া বাইরের আর কারও পক্ষে সেটার অবস্থান জানবার উপায় নেই-আশ্চর্য হয়ে দেখলাম লোকটা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো এবং যেন রোজই ব্যবহার করছে এমনি অভ্যস্ত হাতে আমার স্ত্রীর মস্ত বড় অয়েল পেন্টিং ছবিটা দেয়াল থেকে সরিয়ে সিন্দুকের ডালা খুলে ফেললো একটা চাবি লাগিয়ে। গতকাল সকালেই সব টাকা সরিয়ে ফেলেছিলাম আমাদের বাড়ির একটা গুপ্ত কক্ষে। মাত্র হাজার পাঁচেক ছিলো ওখানে তোড়া বাঁধা অবস্থায়। টাকা কটা পকেটে ফেলে অনেকক্ষণ ধরে সিন্দুকের সমস্ত জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলো লোকটা। তারপর, বিছানার পাশে এসে বললো, কই চাবিটা তো দেখছি না! ওটা কোথায়?
কিসের চাবি? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
ন্যাকামী রাখুন, মি .চৌধুরী। আপনি স্পষ্ট জানেন আমি কোন চাবির কথা বলছি। এই বাড়ির গুপ্ত ঘরের চাবিটা ভালোয় ভালোয় বের করে দিন।
পুরুষানুক্রমে আমরা এই জমিদার বাড়িতে বাস করছি। বাবার মুখে শুনেছি আমাদের কোনও পূর্বপুরুষ সমস্ত ধনরত্ন নিরাপদে রাখবার জন্যে এ বাড়িতে একটা গুপ্তঘর তৈরি করিয়েছিলেন অতি গোপনে সে কালের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ কারিগরকে দিয়ে। এবং যেদিন ঘরটা তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল সেদিন সব কজন কারিগরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন তিনি। সেই ঘরের চাবিটা এমন বিচিত্রভাবে তৈরি এবং সেটা খুলবার কায়দা এমন বিশেষ রকমের যে গুপ্তঘরটা সম্পূর্ণ নিরাপদ রইলো। কেবলমাত্র বংশের বড় ছেলের অধিকার রইলো ঐ চাবিটা পাবার এবং ঘরটা খোলার কৌশল জানবার। অবাক হয়ে গেলাম। এতো রাতে আমার ঘরে ঢুকে অপরিচিত এক লোক ঐ চাবিটা দাবি করছে কেন? বললাম, চাবিটা আমার কাছে নেই।
নিশ্চয়ই আছে।
বংশের বড় ছেলে আপনি। এ চাবি আপনার কাছেই আছে।
আমার কাছে ছিলো, কিন্তু সেদিন গোয়ালন্দ থেকে ফেরবার পথে নারায়ণগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় নেমেও ছিলাম কদিন থাকবো বলে, কিন্তু ঢাকা থেকে জরুরী টেলিফোন পেয়ে চলে এসেছি স্যুটকেস ওখানে রেখেই। চাবিটা সেই স্যুটকেসের মধ্যে আছে।
আপনার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করলাম না, চৌধুরী সাহেব। কিন্তু তবু আপনাকে একটু ভেবে দেখার সময় দিচ্ছি। আগামী শুক্রবার রাত আটটায় রেসকোর্সের মধ্যেকার কালীমন্দিরে আপনি নিজে গিয়ে সে চাবি দিয়ে আসবেন। যদি অন্যথা হয়, আর যদি পুলিশের সাহায্য নেবার চেষ্টা করেন তবে মনে রাখবেন আপনার গচ্ছিত সমস্ত ধনরত্নের চাইতে যা আপনি বেশি মূল্যবান মনে করেন আপনার সেই বংশের ইজ্জত আমি নষ্ট করে দেবো। টর্চের আলোটা নিভে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকবার পর আমি বললাম, আমার একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।
কোনও সাড়াশব্দ নেই। বেড সুইচটা টিপে ঘরের আলো জ্বেলে দেখলাম ঘরে কেউ নেই।
সবাই চুপ করে আগাগোড়া ঘটনাটা শুনে গেল। মিঃ সিম্পসন বললেন, আপনি বংশের ইজ্জতের ভয় করেন না? পুলিসের কাছে এলেন কেন?
বংশের ইজ্জতকে আমি সবচাইতে বড় বলে মনে করি, মি. সিম্পসন। আমি ক্ষুদ্র হতে পারি কিন্তু আমার বংশ মস্ত বড়–সেটাকে আমার সব সময় সকলের চেয়ে উপরে স্থান দিতে হবে। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে একজন ডাকাতের হুমকিতে যদি ভয়ে আমি জড়সড় হয়ে যাই এবং ধনরত্ন তার হাতে তুলে দিই তবে আমি নিজের কাছে একেবারে ছোটো হয়ে যাবো। কাল সারারাত ধরে ভেবেছি, কি করবো। একবার মনে হয়েছে, চাবিটা দিয়েই দিই-পরক্ষণেই আবার নিজের ভেতর থেকে কে যেন গর্জন করে বলেছে,
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
ভালই করেছেন, চৌধুরী সাহেব। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে, আপনার বংশের ইজ্জত কি করে নষ্ট হতে পারে তার কোনো ইঙ্গিত পেয়েছেন কি?
সরাসরি কোনো ইঙ্গিত পাইনি। তবে মনে হয় সে আমার একমাত্র কন্যা রীণার প্রতিই ইঙ্গিত করেছে। এবং সেটাই আমাকে সবচাইতে বেশি অস্থির করে তুলেছে। আমার অবিবাহিতা এই যুবতী কন্যাকে যদি সে কোনও সুযোগে কোনো রকম অপমান করে তবে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
আপনি নিশ্চিত থাকুন, মি. চৌধুরী। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে আমরা আপনাকে প্রোটেকশন দেবো।