নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলো নেসার আহমেদ। পরনে ওয়াটারপ্রুফ। আর পায়ে গামবুট। হাতে সদ্য প্রকাশিত ইংরেজি একটা দৈনিক সান্ধ্য পত্রিকা। দোতলায় একফালি লম্বা বারান্দা হারিকেনের মৃদু আলোয় আলোকিত। কুৎসিত দর্শন একজন প্রহরী সালাম ঠুকে সরে দাঁড়ালো। কোনও প্রত্যুত্তর না করে নেসার আহমেদ ডানধারের একটা ঘরে মৃদু করাঘাত করলো। একজন সুদর্শনা ভৃত্যশ্ৰেণীয় যুবতী দরজা খুলে দিলো। অত্যন্ত সুসজ্জিত এই কক্ষে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। ওয়াটারপ্রুফ ও গামবুট খুলে দিলো যুবতী। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বর্মা চুরুট ধরালো নেসার আহমেদ, তারপর বললো, মোতিয়া, কোরবান আলী ফিরেছে?
জ্বী।
ডেকে নিয়ে আয় এ ঘরে।
একটা ভেজানো দরজা খুলে পাশের ঘরে চলে গেল মোতিয়া। অল্পক্ষণ পরেই ঘরে এসে ঢুকলো কোরবান আলী। সেলাম করে এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে সে। কিছুক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে চুরুট টানবার পর নেসার আহমেদ বললো, বিছানার ওপর থেকে কাগজটা নিয়ে এসো।
হুজুর, এ তো আপনার ছবি! আশ্চর্য হয়ে কোরবান আলী পত্রিকাটা তুলে নিলো বিছানার ওপর থেকে। সান্ধ্য পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি বেরিয়েছে নেসার আহমেদের। নেসার বললো, এবং ছবিটির নিচে লেখা আছে এই লোকটি একজন খুনী আসামী। যে একে ধরে দিতে পারবে, অথবা এর সম্পর্কে পুলিশে খবর দিতে পারবে তাকে উপযুক্ত পুরস্কার দেয়া হবে।
কিন্তু আপনার ছবি পেলো কোথায় ওরা?
সে কথাই তো ভাবছি। যাক, এতে ভয় পাবার কিছুই নেই। কালই আমার ভোল সম্পূর্ণ পালটে যাবে। পুলিশের কেউ আমার টিকিও স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে সেই ল্যাংড়া লোকটাকে নিয়ে। দুই দুই বার আমার সাথে ওর টক্কর লেগেছে এই একমাসের মধ্যে এবং প্রতিবারই ছলে বলে কৌশলে সে আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। অদ্ভুত ধূর্ত এবং কৌশলী এই লোকটা। একে শায়েস্তা করা এখন আমার প্রথম কাজ।
আমাদের একজন লোককে লাগিয়ে রেখেছি ওর পেছনে হুজুর। ছায়ার মতো সে অনুসরণ করছে তাকে।
, কার কথা বলছে, শুকুর? সে এখন হাসপাতালে, বাঁচে কি মরে ঠিক নেই। ধানমণ্ডি লেকের ধারে ঝোঁপের পাশে কাল সারারাত পড়েছিল অজ্ঞান হয়ে। ভোরে লোকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, ল্যাংড়া লোকটাই ওর এ অবস্থা করেছে।
কাল থেকেই অন্য লোক লাগিয়ে দেবো হুজুর।
তা দিও। কেবল ওর আস্তানাটা বের করতে পারলেই বাকি কাজ শেষ করতে সময় লাগেবে না। মনে রেখ, যে তিনটে কাজ হাতে নিয়ে আমরা ঢাকায় এসেছি, তার প্রথমটা সমাপ্ত হয়েছে। বাকি দুটোও অল্পদিনেই হয়ে যাবে। এখন চতুর্থ কাভ হচ্ছে এই ল্যাংড়াকে শায়েস্তা করে মিশরের দিকে রওনা হওয়া।
মিশরে কেন?
পরে জানতে পারবে। এখন আজকের রাতের জন্যে প্রস্তুত হয়ে নাও।
.
ধানমণ্ডি লেকের ধারে প্রতিদিন বিকেল বেলায় দুটি যুবক যুবতী এসে বসে, হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে পুল পর্যন্ত চলে যায়–তারপর সন্ধ্যার আগেই মেয়েটি ফিরে যায় বাড়িতে। অত্যন্ত দামি পোশাক পরিচ্ছদ মেয়েটির পরনে। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে বোঝা যায় স্পষ্ট। ছেলেটি সাদাসিধে পাঞ্জাবী পাজামা পরে আসে। গল্পে হাসিতে বিভোর হয়ে যায় ওরা। আশেপাশে আর কেউ থাকতে পারে, এবং তাদের চালচলন লক্ষ্য করতে পারে, সে খেয়ালই যেন নেই ওদের। ।
কিন্তু কিছুদিন ধরে একজন খোঁড়া লোকের দিকে লক্ষ্য না দিয়ে পারেনি ওরা। লোকটা যেমন লম্বা তেমনি চওড়া। রোজই মস্ত একটা কালো গাড়িতে করে আসে ক্র্যাচের ওপরে ভর দিয়ে। দামি নীল স্যুট পরিহিত এই ভদ্রলোক ওরা, যেখানটায় বসে তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে লেকের পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখে। ওরা তার দিকে চাইলেই মিষ্টি করে হেসে মাথাটা একটু নত করে, তারপর নিজের জায়গায় গিয়ে বসে থাকে গোধূলি আকাশের সব রঙ মুছে না যাওয়া পর্যন্ত।
কদিন ধরে মেয়েটি আর আসে না। ছেলেটি রোজ অপেক্ষা করে ওর জন্যে সন্ধ্যে পর্যন্ত। তারপর সাঁঝের মতোই আঁধার হয়ে আসে যুবকের মুখ, উঠে চলে যায় সে।
সেদিনও বিকেল বেলা একা বসে তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবছে যুবক, এমন সময় চমকে উঠলো ঘাড়ের ওপর কার মৃদু স্পর্শে। চেয়ে দেখলো পাশে এসে বসেছে সেই প্রকাণ্ড দেহী খোঁড়া লোকটা। কোনও ভূমিকা না করেই বললো সে লোক, কি হয়েছে। কলিম, তোমার বান্ধবী আসে না কেন?
প্রথমে অপরিচিত লোকের মুখে নিজের নাম শুনে বিস্কিত হলো যুবক, তারপর ভাবলো ওর হৃদয়ের গভীরতমবেদনার কথা হঠাৎ একজন অপরিচিতের কাছে বলবেই বা কেন সে? কিন্তু ভদ্রলোকের সাহনুভূতিশীল মুখের দিকে চেয়ে কলিমের উগ্রতাবটা মুহূর্তেই কোমল হয়ে এলো, এই লোকের কাছে মনের সব কথা বলা যায়। কোনো ভূমিকা না করে সহজ ভাবেই সে বললো, ওর বাবা আসতে বারণ করে দিয়েছেন।
কেন?
আমি যে চাষার ছেলে।
তুমি যে একজন কৃতী ছাত্র, এবার সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে, পাস করেছে, সে খবর নিশ্চয়ই ওর বাবা জানে না?
জানেন। আমার বাবার মুখের ওপর চৌধুরী সাহেব বলে দিয়েছেন, চাষার ছেলের সাথে ওঁর মেয়ের বিয়ে হতে পারে না।
তিনি জানেন না যে এতে তীর মেয়ের সম্মতি আছে?