এই রকম? আরেকটা টুকরো লাগালেন মি. সিম্পসন।
অনেকটা হয়েছে, কিন্তু আগাটা ওপর দিকে তোলা ছিলো।
এই রকম?
হ্যাঁ। আর মাথার চুলটা উল্টোদিকে আঁচড়ানো ছিলো। সিথি ছিলো না।
এই রকম?
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক।
এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মানুষের মুখ তৈরি হয়ে গেল। খোদা বক্সই বলে দিলো কোন অংশটা কেমন ছিলো। কিন্তু মূর্তিটা যখন তৈরি হয়ে গেল তখন ও পরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললো, হুজুর, আজব কাণ্ড, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, এই লোকটাই কাল রাতে এসেছিল!
মি. সিম্পসন তাঁর ইলেকট্রনিক ফ্ল্যাশ গান কিট করা লাইকা ক্যামেরা দিয়ে মূর্তিটার দুটো স্ন্যাপ নিয়ে আবার মূর্তিটাকে খুলে বাক্সে ভরে ফেললেন। তারপর শহীদকে বললেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড থেকে এনেছি এটা। এই বাক্সটাকে কি বলে জানো? একে বলে
Identi-kit.
বুদ্ধিমান ছেলে! তুমি জানলে কি করে? আবাক হলো মি. সিম্পসন।
আমেরিকায় ম্যাকডোনান্ড সাহেবের আবিষ্কার তো? পাশ্চাত্যের সমস্ত পুলিস মহলে একটা যুগান্তর এনে ফেললো এই নতুন আবিষ্কার, তার খবর রাখা এমন কি আর আশ্চর্যের হলো?
এই লোকটার চেহারা পেলাম, এর আঙ্গুলের এবং পায়ের ছাপও পেয়েছি। এবার চলো। এখানে আর আমাদের কোনো কাজ নেই। প্ররেম হচ্ছে,দরজা বন্ধ অবস্থায় চারজন ছিলো এ ঘরে। একজন মৃত। বাকি তিনজন গেল কোথায়
আমি মৃতদেহটা একবার দেখবো। শহীদ বাধা দিয়ে বললো।
ওতে দেখার কিছু নেই। ছেলেমানুষ শুধু শুধু লজ্জা পাবে। দেহটা সম্পূর্ণ নগ্ন।
উত্তর না দিয়ে শহীদ এগিয়ে গেল বিছানাটার দিকে। মি. সিম্পসন নিজের কাঁধটা একটা বিশেষ বিদেশী কায়দায় ঝাঁকিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে ব্যালকনিতে চলে গেলেন।
বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো শহীদ। মৃতদেহের ওপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেললো। চোখ দুটো খোলা-এবং তাতে ফুটে রয়েছে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কি যেন দেখছে সে এখনও। আলতোভাবে শহীদ লাশটাকে ডান দিকে পাশ ফিরিয়ে দিলো। ওমনি বিছানার ওপর ছোট্ট একটা জিনিসের ওপর দৃষ্টি পড়লো তার। নিঃশব্দে সেটা তুলে পকেটে ফেললো সে। লাশটার আপাদমস্তকে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সেটাকে ঢেকে রেখে ঘরটা একবার পরীক্ষা করে দেখলো শহীদ, তারপর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। মি. সিম্পসন বললেন, এই যে পাম গাছটা দেখছো-ওটা এই বারান্দা থেকে কয় ফিট হবে আন্দাজ করো তো।
তা, পনেরো ফিটের কম হবে না।
কোনও মানুষের পক্ষে এখান থেকে লাফিয়ে ওখানে যাওয়া বা ওখান থেকে লাফিয়ে এখানে আসা সম্ভব?
উহুঁ। অসম্ভব।
ঠিক মানুষের পক্ষে অসম্ভব, কিন্তু শিম্পাঞ্জী, ওরাংওটাং বা গরিলা জাতীয় কোনও জন্তুর পক্ষে অসম্ভব নয়। তাই না? আমার কোনই সন্দেহ নেই যে একজন। খোঁড়া লোক এই ধরনের কোনও জন্তুর পিঠে চড়ে এই ঘরে এসেছিল কাল রাতে এবং সেই জন্তুটাই তাকে আবার পিঠে করে নিয়ে অনায়েসে লাফিয়ে গিয়ে ঐ গাছ ধরে নেমে গেছে।
প্রমাণ?
প্রথম প্রমাণ, ঐ গাছটার তলায় তাদের পায়ের চিহ্ন আছে। দ্বিতীয় প্রমাণ, এই ঘরেও তাদের পায়ের চিহ্ন পেয়েছি। আর তৃতীয় প্রমাণ, সদর দরজা বন্ধ থাকা অবস্থায় ঐ গাছটা ছাড়া ঘরে ঢুকবার বা এ ঘর থেকে বেরোবার অন্য কোনও উপায় নেই।
গাছের তলায় কি তিনজনেরই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে?
না। রহস্যটা এখানেই। তৃতীয় ব্যক্তিটা যে কি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল বোঝাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভোজবাজীর মতো সে অদৃশ্য হয়ে গেছে হাওয়ায়।
আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন মি. সিম্পসন, তা ছাড়া কেনই বা এই নর্তকীকে খুন করা হলো? তৃতীয় ব্যক্তির সাথে খোঁড়া লোকটার কি সম্পর্ক? মনে হচ্ছে এর পেছনে আছে একটা বিরাট দল-বিশেষ কোনও কারণে হয়তো
শহীদ মাঝপথে বাধা দিয়ে বললো, মি. সিম্পসন, আমি এখন বাড়ি ফিরবো, আপনি কি এখানেই থাকবেন?
না। আমিও একটু অফিসে যাবো। এই পায়ের চিহ্ন, আঙ্গলের ছাপ খুনীর ফটোগ্রাফ সব কিছু আজই ডেভেলপ করে ফেলতে হবে বারোটার মধ্যে। চলো তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাই।
চিন্তিতমুখে শহীদ ফিরে এলো তার ড্রইংরুমে। একটা সোফায় আধ ঘন্টা সে চোখ বন্ধ করে একটার পর একটা সিগারেট পোড়ালো। তারপর তার মুখে মৃদু হাসির চিহ্ন ফুটে উঠলো। চোখ খুলেই গলা ছেড়ে হাঁক দিলো, গফুর।
ডাকছো দাদামণি?
চা নিয়ে আয়–আর তোর কামাল ভাইকে একটু ফোন করে দে এক্ষুণি যেন চলে, আসে এখানে। যা, তাড়াতাড়ি কর।
.
০৪.
ঢাকার ইন্দ্রপুরীতে একটা বহুকালের জীর্ণ দুইতলা জামিদার বাড়িতে দুর্ধর্ষ দস্যু নেসার আহমেদ গুপ্ত আস্তানা গড়েছে বছর পাঁচেক হলো। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব শহরেই এর একটা করে আড্ডা আছে। কয়েক বছর ধরে এই দস্যুর পেছনে আঠার মতো লেগে থেকেও একে ধরতে পারেনি পুলিস আজও। তিন তিন বার পুলিস প্রায় ধরেই ফেলেছিল ওকে, কিন্তু প্রতিবারেই সে অভাবিত কৌশলে পিছলে বেরিয়ে গেছে; ধরা পড়েনি।
সেদিনও সারা আকাশ জুড়ে মেঘভার। বৃষ্টিটা ছাড়ছে না কিছুতেই। সারাদিন সূর্যের মুখ দেখা যায় না একবারও। মাঝে মাঝে আকাশটা পরিষ্কার হয় একটু অক্ষণের জন্য বৃষ্টি থামে। তারপর আবার কালো হয়ে আসে আকাশ, ঝর ঝর করে আবার আরম্ভ হয় সেই এক ঘেয়ে অক্লান্ত বরিষণ।