কুয়াশার গম্ভীর কণ্ঠস্বর সমস্ত ঘরটা গম গম্ করতে থাকলো। ক্র্যাচের ওপর ভর দিয়ে একটা পা টেনে টেনে বেরিয়ে গেল কুয়াশা। বেদনায় শহীদের মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে সে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে কুয়াশার পেছন পেছন।
কুয়াশা ততক্ষণে চকচকে কালো একটা শেভ্রোলে গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসে সশব্দে
দরজা বন্ধ করেছে। ছুটে গিয়ে শহীদ বললো, আমার একটা কথা শুনে যাবে না?
না না। কোনও কথা শুনতে চাই না আমি! বেঈমান!
কালো ধোঁয়া ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল গাড়িটা। পেছনের সীটে বসে আছে সেই প্রকাও ভয়ঙ্কর কুৎসিত গরিলা।
.
০২.
সেই সন্ধ্যারই আর একটি ঘটনা। ঢাকার শাহবাগ অঞ্চলে বিশিষ্ট এক হোটেলের তেতলায় একখানা ডবলসিটেড কামরা। মিশরের নাম করা নৃত্যশিল্পী জেবা ফারাহ্ এসে এখানে উঠেছে চার পাঁচ দিন হলো। লাহোর, করাচী, রাওয়ালপিণ্ডিতে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে এসেছে এই নর্তকী গত তিন মাস ধরে। টিকেট বিক্রির হার কমে না গিয়ে বরঞ্চ বেড়েই গিয়েছে দিনের পর দিন। নাচের আসরে তার গায়ে কাপড় চোপড়ের বালাই কমই থাকে। প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় নির্লজ্জভাবে সে নেচে যায় একের পর এক জিপসী ড্যান্স, বেলী ড্যান্স, স্নেক ড্যান্স আরও কত কি! তার সুন্দর সুঠাম অর্ধনগ্ন দেহ দর্শকদের লোভাতুর করে তোলে। দলে দলে লোক ভিড় করে দাঁড়ায় গেটের কাছে শো ভাঙার পর এই লাস্যময়ী কামিনীকে একবার কাছে থেকে দেখবে বলে। য়ে ব্যবসায়িক তাকে। প্রতিরাতের জন্য তাকে হাজার টাকা দিয়েও তারা হাজার হাজার টাকা করে নিয়েছে। কিন্তু কেন যেন জেবা ফারাহ কোথাও বেশিদিন থাকেনি। কি এক অজ্ঞাত শঙ্কায় যেন সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে অন্য কোথাও পালিয়ে যাবার জন্যে। আজ পাঁচ দিন হলো সে করাচী থেকে ঢাকায় চলে এসেছে। আজ সন্ধ্যায় প্রসাধন সমাপ্ত করে সে যেই রওনা হবে ভাবছে অমনি টেলিফোন এলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যে আজকের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে। রিসিভার নামিয়ে রেখে ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো জেবা। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে আপন। মনেই হাসলো সে।
ধবধবে সাদা দামী একটা আলখাল্লায় ওর কাঁধ থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত ঢাকা। কাপড়টার সামনের দিকটা আগাগোড়াই চেরা। কটীতে শুধু একটা কালো রেশমী বেন্ট বাঁধা। কোমরের দড়িটা খুলে আলগোছে গা থেকে কাপড়টা ছেড়ে দিলো জেবী। কার্পেটের ওপর আলুথালু হয়ে খসে পড়ে গেল সাদা নাইলনের আলখাল্লাটা। ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নায় এবার ফুটে উঠলে এক সুন্দরী নারী দেহের ছায়া। পরনে তার বহুমূল্য সাদা পাথর বসানো কালো বক্ষাবরণ। ঝিকমিক করে উঠলো সেটা ঘরের উজ্জ্বল আলোতে। আর কোমরে জড়ানো জরীর কাজ করা ছোটো একটা মিশরীয় পরিচ্ছেদ। সেটাও কালো। অপলক দৃষ্টিত সে কিছুক্ষণ নিজ তনুশোভা নিজেই উপভোগ করলো। তারপর আবার হেসে উঠলো আপন মনে।
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করলে জেবার কাফ্রী দেহরক্ষী খোদা বক্স। মিশরীয় ভাষায় বললো, কালকের সেই ভদ্রলোক আবার আজ এসেছে। ভিতরে আনবো?
নিয়ে এসো।
ভিতরে এলো একজন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সের যুবক। দামী কাপড় চোপড় দেখে এক নজরেই বোঝা যায় ধনীর দুলাল। অতিমাত্রায় মদাসক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছে চোখের কোণে। তার আধ বোজা চোখ এবং এলোমেলো পা ফেলা দেখে হেসে ফেললো জেবা। তারপর বললো, এসেছে বাবুজী। কথার ঠিক আছে দেখছি। আমার জন্যে কি আনলে দেখি? শুধু টাকায় চলবে না, আজ আমাকে কিছু উপহার দিতে হবে, কাল বলেছি না!
এনেছি গো এনেছি তোমার জন্য উপহার এনেছি, এই যে আমার উত্তপ্ত প্রেমিক হৃদয়, এ হৃদয় তোমাকে উপহার দিলাম।
যাও ঠাট্টা করো না। কি এনেছো দেখি?
যুবক কোটের পকেট থেকে বের করলো হীরে বসানো একটা মহামূল্যবান জড়োয়া সেট। বিস্মিত জেবা এগিয়ে গিয়ে হাতে নিলো হারটা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে উল্লসিত হয়ে বললো, তুমি মস্ত বড় শেঠ, বাবুজী?
গর্বের হাসি ফুটে উঠলো যুবকের ঠোঁটে। জেবাকে কাছে টেনে নিয়ে নিজ হাতে পরিয়ে দিলো হারটা তার গলায়। তারপর তার সারা দেহের ওপর একবার লোভাতুর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে গেল। চট করে সরে গিয়ে জেবা বললো, ধীরে বুজী, ধীরে। দরজাটা খোলা আছে সে খেয়াল নেই বুঝি?
দরজাটা ভালো করে লক্ আপ করে উজ্জ্বল বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে একটা হালকা সবুজ আলো জ্বেলে দিলো জেবা। গুন গুন করে একটা মিশরীয় সুর ভাঁজতে ভাজতে সহজ সচ্ছলভাবে আলগোছে একটা বোতল থেকে দুটো গ্লাস ভর্তি করে শ্যাম্পেন ঢেলে নিয়ে বিছানার পাশে টিপয়ের ওপর রাখলো।
জেবার দুই কাঁধে দুহাত রাখলো যুক। আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল। তারপর এক সময় ক্ষীণ কণ্ঠে বললো, তোমার হাতটা গলা থেকে একটু সরাও বাবুজী, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু হাত দুটো সরলো না। কিছুক্ষণ ছটফট করলো জেবা, তারপর প্রাণপণে হাত দুটো সরাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই সে হাত দুটো সরলে না-সাঁড়াশীর মতো চেপে বসলো আরও ওর কণ্ঠনালীর ওপর। ধাক্কা দিয়ে যুবককে সরিয়ে দিতে চাইলো জেবা, কিন্তু নড়াতে পারলো না। হাতের ধাক্কায় একজোড়া গোঁফ খসে পড়লো যুবকের ঠোঁটের ওপর থেকে। মুহূর্তে চিনতে পারলো সে। শিউরে উঠে বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো জেবা–