কি?
কিছু না।
ডাকলে যে?
এমনি তোমাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
দুজনেই হাসলো। তারপর চুপ করে বোধহয় একই সাথে ভাবতে লাগলো আগামী দশ তারিখের কথা।
এমন সময় কাছেই একটা পায়ের শব্দে দুজনেই চমকে উঠলো। তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে কুয়াশা। কলিমের কাঁধে একটা হাত রেখে কুয়াশা বললো, আমি আজ চলে যাচ্ছি এদেশ ছেড়ে। ভাবলাম যাবার আগে তোমাদের বলে যাই। তোমাদের বিয়েতে উপহার দেবার মতো কিছুই নেই আমার। অনেক টাকা উপার্জন করেছি আমি, কিন্তু সে সবই চুরি ডাকাতির টাকা– সে টাকায় কেনা কোনও উপহার দিয়ে তোমাদের আগামী দিনের পবিত্র সুন্দর সূচনাকে আমি অশুত করবো না। তাই বিদায় কালে আমি শুধু মুখেই তোমাদের আর্শীবাদ করে যাচ্ছি, চির সুখী হও। কল্যাণময় হোক তোমাদের জীবন! উজ্জ্বলতর হোক তোমাদের প্রেম!
অন্ধকারে মিলিয়ে গেল কুয়াশার ছায়ামূর্তিটা।
.
০৯.
চৌধুরী বাড়ির গেট ছাড়িয়েই হঠাৎ কামাল শহীদকে বললো, কথাগুলো কিন্তু অন্যায় বলেননি মি. সিম্পসন। আমিও এ নিয়ে কদিন ধরে অনেক মাথা ঘামাচ্ছি। কুয়াশার প্রতি আমাদের এই অহেতুক দুর্বলতা কেন? একটা দস্যুর সাথে আমাদের কিসের এতো দহরম-মহরম? এক সময় হয়তো সে বন্ধু ছিলো–তা আমরা ওকে চিনতাম না বলে তাই বলে কি ও যা খুশি অন্যায় কাজ করে যাবে, আমরা কিছুই বলবো না? এই কি আমাদের ব্রত–এই কি আমাদের ন্যায়-নীতি? এর কি জবাব দিবি তুই, বল?
শহীদের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। মাথাটা সামনের দিকে একটু নিচু করে কী যেন ভাবতে লাগলো সে–কোনও উত্তর দিতে পারলো না। সত্যিই তো, এর কি জবাব দেবে সে? অন্যায়কে সে প্রশ্রয় দিচ্ছে। নিজের বিবেককে সে কোন ব্যাখ্যা দিয়ে শান্ত করবে? এ এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। সমস্ত মায়া-মোহ-দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে যদি ন্যায়ের পথে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে না-ই পড়তে পারলো, তবে কেন মিছেমিছি ভড়ং করছে সে? কুয়াশার পক্ষে বা বিপক্ষে, কোনও দিকেই কিছু কাজ করতে পারছে না সে। কেউ যেন দুহাত বেঁধে নিরুপায় করে রেখেছে ওকে। ছি ছি, এ কী অবস্থায় পড়লো সে?
গোয়েন্দাগিরি আমি ছেড়ে দেবো কামাল।
কেন? বিস্মিত কামাল ভ্রূ কুঁচকে চাইলো শহীদের দিকে।
দিনের পর দিন নিজের কাছে নিজে ছোটো হয়ে যাচ্ছি।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সোজা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবি না?
না।
এই তোর মনের বল? এই তোর চরিত্রের দৃঢ়তা? এই তোর কর্তব্যনিষ্ঠা? তুই কী রে?
কোনও উত্তর নেই শহীদের মুখে। বেদনায় বুঝি কণ্ঠ গোল রুদ্ধ হয়ে। একটা মোড় ঘুরতেই কামাল বললো, আমাকে নামিয়ে দে এখানে, একটু কাজ আছে।
.
প্রচণ্ড ঝড় এবং সেই সাথে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে শহীদের মরিস মাইনর গাড়িটা এসে থামলো মি. সিম্পসনের অফিসের সামনে। সিম্পসন প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসেছো তো?
না। আমি চৌধুরী সাহেবের বাসা থেকে সোজা আসছি।
বেশ করেছে। এখন আমার সাথে কিছু খেয়ে নাও তো, আজ সারারাত হয়তো জাগতে হতে পারে বনে-জঙ্গলে।
আপনি খান, আমার ক্ষিধে নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কি? হঠাৎ শিকারের ঝোঁক নাকি?
শিকার? তা কিছুটা শিকার তো বটেই। গরিলা শিকার। আজ আমার শেষ চেষ্টা। আজও যদি বিফল হই তবে আর কুয়াশাকে ধরতে পারবো না কোনদিন।
আমাকে আর এর মধ্যে টানছেন কেন, মি. সিম্পসন। অবিশ্বাসের পাত্র হয়েও আপনার সাথে একসঙ্গে আমি কাজ করতে পারবো না। আমাকে ডেকে ভুল করেছেন।
ঠিকই করেছি শহীদ। তুমি তো কুয়াশাকে সাহায্য করছে না, আমাকেও বাধা দিচ্ছে না। কেবল ওর ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূর্ণ চেপে যাচ্ছে। এতে অবিশ্বাসের কিছু নেই। আমি বুঝতে পারছি তোমার নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা আছে। আমার সাথে চলো শহীদ। তুমি সাথে থাকলে অনেক লাভ আছে।
মাফ করবেন, মি. সিম্পসন, আমি কচি খোকা নই কিম্বা খেলার পুতুলও নই। আপনি মনে করেছেন, আমি সাথে থাকলে আপনি নিরাপদে আমার আড়ালে থেকে কাজ উদ্ধার করতে পারবেন। আমাকে কুয়াশা কিছুই বলবে না, সেই সুযোগে আপনিও ওর আড্ডায় হানা দেবার বিপদ থেকে রক্ষা পাবেন। কেন? আপনার সাহস নেই? একটা খোঁড়া লোককে এতো ভয় পাবার কি আছে? আপনি একাই যান, মি. সিম্পসন, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না।
শহীদ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিলাতী কায়দায় একবার কাঁধটা ঝাঁকিয়ে নিলেন মি. সিম্পসন, তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন মুচকি হেসে।
.
তুমুল বর্ষণ চলছে বাইরে। রাত নটা সাড়ে-নটা হবে। কুয়াশা তার ল্যাবরেটরীতে বসে নিবিষ্টচিত্তে কি যেন পরীক্ষা করছে। শান্ত সৌম্য চেহারা তার।
ঘরের এক কোণে মোটা শিকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে গোগী। বাড়ি থেকে এদিকে ওদিকে বেরিয়ে গিয়ে কি বিপদ বাধিয়ে বসবে সেজন্যে এই ব্যবস্থা।
কিছুক্ষণ ধরে একটু বেশি চঞ্চল হয়ে উঠেছে গোগী। ছটফট করছে, আর শিকলটা ছিড়বার চেষ্টা করছে। কুয়াশা একবার ওর দিকে চেয়ে বললো, Quite Gogi! চুপচাপ বসে থাকো, কাজ করছি এখন।
কিন্তু আরো চঞ্চল হয়ে উঠলো গোগী। কি যেন বোঝাবার চেষ্টা করছে কিন্তু বোঝাতে পারছে না।
ঠুং ঠাং শিকলের শব্দে বিরক্ত হয়ে কুয়াশা আবার ফিরে চাইলো গোগীর দিকে। একমুহূর্ত গোগীর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলো কি যেন। তারপর বিদ্যুৎ বেগে ঘুরে দাঁড়ালো দরজার দিকে।