অনেক রকম প্রলোভন এবং ভয় প্রদর্শনেও যখন জেবা কিছুতেই দিলো না নক্সাটা, বারবারই পিছলে বেরিয়ে গেল ওর হাতের মুঠি থেকে তখন তাকে হত্যা করে নক্সাটা ছিনিয়ে নেবার সঙ্কল্প নিয়েই সে এসেছিল ঢাকায়–এবং তাই সে করেছে।
গল্পটা মন্দ লাগলো না শুনতে। কিন্তু এ গল্প পেলে কোথায় তুমি শহীদ? মৃদু হেসে মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন।
কিছুটা আমার কল্পনা, কিছুটা কাফ্রী দেহরক্ষী খোদা বক্সের কাছ থেকে নানান কথার ছলে বের করে নেয়া আর বাকিটুকু বাস্তব প্রমাণ পেয়েছি। নেসারের আজ্ঞায় কুয়াশা যে তাবিজটা ওর গলা থেকে টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেল, তারই মধ্যে রয়েছে সেই নক্সাটা। এই তাবিজেরই কিছুটা মোম পেয়েছিলাম আমি জেবার বিছানার ওপর। নেসার আহমেদ তাবিজের মুখে আটকানো এই মোম খুলে পরীক্ষা করে নিয়েছিল সত্যি সত্যিই নক্সাটা আছে কিনা তাবিজের মধ্যে।
তাহলে তুমি বলতে চাও কুয়াশাও জানতো এই নক্সার কথা?
নিশ্চয়ই। সেও গিয়েছিল জেবার ঘরে এরই জন্যে। কিন্তু কিছুটা দেরি করে ফেলেছিল।
যদি স্বীকার করে নিই এরই জন্যে কুয়াশাও গিয়েছিল সেখানে, তবে সে নেসারের কাছ থেকে সেটা কেড়ে নিলো না কেন?
কুয়াশা যখন সে ঘরে উপস্থিত হলো, ততক্ষণে নেসার সরে পড়েছে।
কোন্ পথে? নেসার আহমেদ অদৃশ্য হলো কোন পথে?
একটু হেসে শহীদ বললো, কেন, সদর দরজা দিয়ে। এটা তো সাধারণ কথা। একটু কল্পনার আশ্রয় নিলেই বোঝা যায়। জেবা ফারাহকে হত্যা করে নেসার নিঃশব্দে অপেক্ষা করেছে সেই কামরায়। খোদা বক্স যখন দরজায় করাঘাত করে তখনও সে চুপচাপ বসে আছে সে ঘরে। তারপর যখন মুহূর্মুহূ টেলিফোন বাজতে আরম্ভ করলো তখন নিশ্চিন্ত মনে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে গেছে সে।
এটা হতেই পারে না। পুলিস এসে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ পেয়েছে। সিম্পসন আপত্তি তুললেন।
তাতো পাবেই। দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ পাবেই। নেসারের অন্তর্ধানের অল্পক্ষণ পরেই কুয়াশা এসে উপস্থিত হয়েছে পাম গাছটা বেয়ে। দরজাটা খোলা দেখে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে নক্সাটা খুঁজেছে তন্ন তন্ন করে, তারপর না পেয়ে আবার গাছ বেয়ে নেমে গেছে গরিলার সাহায্যে।
I see! এতক্ষণে বুঝলাম! এই সাধারণ কথাটা আমার মাথায় খেলেনি শহীদ। সেই সেদিন থেকে ভেবে মরছি তৃতীয় লোকটা অদৃশ্য হলো কোন পথে। যাক আর একটা কথা। সেদিন কুয়াশার জেবার ওখানে যেতে দেরি হয়ে যেতো না, যদি সে তোমার বাসায় সময় নষ্ট না করতো। সে তোমার বাসায় গিয়েছিল একথা আমি যেমন জানি, তুমিও জানো; কিন্তু আমার কাছে অস্বীকার করলে কেন?
এখনও অস্বীকার করছি। যদি সে গিয়ে থাকে, গিয়েছে আমার অজান্তে।
তোমারই বৈঠকখানায় একটা জ্যান্ত গরিলা কারও সাথে ধস্তাধস্তি করে গেল, ঝনঝন করে একটা আলমারির কাঁচ ভেঙে গেল, আর তুমি সে সম্বন্ধে কিছুই জানো না? কুয়াশার প্রতি তোমার এই দুর্বলতার কারণ কি? তোমরা কুয়াশাকে সব সময় আড়াল করে রাখছো কেন? এর কি জবাব দেবে তোমরা শহীদ! তোমাদের সাথে কুয়াশার কি সম্পর্ক? একটা হীন দস্যুর সাথে তোমাদের কি ধরনের যোগাযোগ থাকতে পারে? তোমরা …
কলিম বাধা দিয়ে বললো, কুয়াশাকে হীন দস্যু বলেছেন কেন মি. সিম্পসন। সে তো কোথাও চুরি বা ডাকাতি করেনি। বরং আমাদের সবাইকে নিজের জীবন বিপন্ন করেও এক সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।
দেখুন মি. কলিম, সরাসরি কোনও ডাকাতি কুয়াশা করেনি ঠিকই, কিন্তু চোরাই মাল তার কাছে আছে। নেসার আহমেদ ডাকাতি করেছে আর কুয়াশা নিয়েছে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে। আইনের চোখে যে চুরি করে আর যে চোরের উপর বাটপারি করে, দুজনেই সমান অপরাধী।
তা অবশ্য ঠিকই। তবে…
আর কোনও তবে নেই এর মধ্যে, মি. কলিম। আমার দুই একটা প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য উত্তর দিতে হবে আপনাকে। এখন একমাত্র আপনিই ভরসা। আপনার কাছ থেকে সঠিক উত্তর পেলে আজই রাতে আমি কুয়াশাকে গ্রেপ্তার করতে পারবো।
বলুন কি প্রশ্ন আপনার।
সেদিন রাতে কি আপনাকে সাহায্য করতেই কুয়াশা নেসারের আজ্ঞায় গিয়েছিল?
হ্যাঁ।
আপনাকে সে-ই চিনিয়ে দিয়েছিল সে আচ্ছা?
হ্যাঁ।
আপনার সাথে তার পরিচয় কতদিনের?
পাঁচ ছয় দিনের।
সে আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো কী স্বার্থে?
কোনও স্বার্থেই নয়। তিনি স্বার্থপরতার ঊর্ধে।
ওর বাড়িতে গিয়েছেন কখনও?
গিয়েছি।
এখন চিনতে পারবেন সে বাড়িটা?
খুব চিনতে পারবো। কিন্তু প্রাণ গেলেও আপনাকে চিনিয়ে দেবো না। এ নিয়ে দয়া করে বৃথা তর্ক করবেন না। আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে আপনার?
কোনও উত্তর না দিয়ে মি. সিম্পসন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। চৌধুরী সাহেবের প্রতি সামান্য একটু মাথা ঝাঁকিয়ে পা বাড়ালেন গেটের দিকে, তারপর কি ভেবে থেমে শহীদের দিকে ফিরে বললেন, শহীদ, এই পার্টিটা সেরেই চলে এসো আমার অফিসে। খুব জরুরী ব্যাপার আছে। ভুলো না কিন্তু।
চলে গেলেন মি. সিম্পসন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। কালো হয়ে মেঘ করেছে আকাশে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে অল্পক্ষণ হলো। প্রচণ্ড দুর্যোগের পূর্বাভাস।
অতিথিদের নিয়ে মি. চৌধুরী চলে গেলেন ড্রইংরুমে। পাশাপাশি বসে রইলো কলিম আর রীণা। রীণার একটা হাত কলিমের হাতে। কলিম মৃদু স্বরে ডাকলো, রিণি!