মি. সিম্পসন উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, এই যে ভদ্রলোক, আমার হাতের বাঁধনটা কেটে দিন তো একটু তাড়াতাড়ি করুন।
কুয়াশা ততক্ষণ এসে দাঁড়িয়েছে মি. সিম্পসনের সামনে।
কেন, এতো তাড়া কিসের? এই বুঝি উপকারের যোগ্য প্রতিদান সিম্পসন? ভেবেছো কেবল হুইসলটায় তিনটে ফুঁ দিলেই কুয়াশা নেসার দুজনকেই একসাথে ধরে ফেলবে? একসাথে দুজনকে গ্রেপ্তার করা এবার আর তোমার কপালে নেই। তোমার সাথে বোঝাপড়া আমার বাকিই থাকলো।
খোলা জানালার ধারে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো কুয়াশা গরিলাটাকে। তাকে পিঠে নিয়ে জানালার বাইরে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়লো গোগী।
.
০৮.
ধানমণ্ডি এলাকায় ঈদগাহের কাছে একটা ছোটো ঘর ভাড়া করে থাকে কলিম। মি. চৌধুরীর নীল মরিস মিনিমাইনরটা এসে থামলো সে বাড়ির সামনে। রীণার পেছনে পেছনে কলিমের ঘরে এসে ঢুকলেন মি. চৌধুরী। একটা চৌকির ওপর কাত হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আকাশ পাতাল ভাবছিল কলিম। হঠাৎ চৌধুরী সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দেখে যতখানি না আশ্চর্য হলো তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠলো কোথায় বসতে দেবে ভেবে। ওকে বিছানা থেকে উঠবার চেষ্টা করতে দেখে চৌধুরী সাহেব একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন।
শুয়ে থাকো, শুয়ে থাকো কলিম। উঠো না। এই যে আমি এখানে বসছি।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লেন মি. চৌধুরী।
এখন কেমন বোধ করছে কলিম? ওষুধগুলো খাচ্ছো তো? কই, ঐ তো ভরা শিশি রয়েছে, একদাগও খাওয়া হয়নি। মাথায় আইস ব্যাগের ব্যবস্থা হয়নি! না কলিম! এখানে তোমার থাকা হবে না।
কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর রয়েছে গায়ে। এবার মাথা নেড়ে বললেন, অসম্ভব। এই অবস্থায় তোমার একা থাকা চলবে না। এক্ষুণি আমি নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে আমার বাসায়। ওখানে রীণা সব সময়ই দেখাশোনা করতে পারবে।
এতক্ষণ চুপ করেই ছিলো কলিম। এবার গভীরভাবে বললো, চাষার ছেলের জন্যে এই ঘরই যথেষ্ট। আমি এখানেই থাকবো।
পাগল ছেলে! এখনও বুঝি অভিমনি যায়নি? সে জন্যে আমি ক্ষমা চাচ্ছি কলিম। আমার সব ভুল ভেঙে দিয়েছে সেই খোঁড়া লোকটা। আমার সেই বংশের মিথ্যা গৌরব ঘুচে গেছে চিরকালের মতো। তুমি তোমার জীবন বিপন্ন করে আমার মেয়েকে রক্ষা করতে পারো; আর আমি এই সামান্য কাজটুকু করার অধিকার পাবো না? আমি কোনো কথাই শুনবো না কলিম, আমি গাড়িটা ঘুরিয়ে রাখছি, তোমরা দুজন জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও জলদি।
গটগট করে বেরিয়ে গেলেন মি. চৌধুরী। এবার রীণা এসে বসলো কলিমের মাথার কাছে। কপালে একটা কোমল হাত রেখে বললো, চলো কলিম! আব্বাজান ঠিকই বলেছেন, এভাবে একা থাকা ঠিক হবে না। নেসার আহমেদ পাগলের মতো তোমাকে আর সেই খোঁড়া লোকটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের বাড়ি দশজন পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ওখানে চলো, তোমার এই অসুস্থ অবস্থায় তোমাকে চোখে চোখে রাখতে পারবো এই আমার সবচেয়ে বড় লাভ।
নেসার আহমেদ? কেন, সে ধরা পড়েনি?
পুলিসের গাড়ি থেকেই কাল রাতে কৌশলে হাতকড়া খুলে উধাও হয়ে গিয়েছে। সে। থানা পর্যন্ত আর নিতে পারেনি ওকে। সেই জন্যেই তো তয়, তুমি চলো আমাদের সাথে।
কিন্তু…
আর কোনও কিন্তু নয় কলিম। চলো লক্ষ্মী! আব্বাজন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গেছেন। আজই সকালে তোমার আব্বাকে টেলিগ্রাম করেছেন, সেই সাথে মাফ চেয়ে লম্বা এক চিঠি দিয়েছেন। দশ তারিখে যে আমাদের বিয়ে!
সত্যিই! লাফিয়ে উঠে বসে কলিম। কি করে এটা সম্ভব হলো?
সত্যি নয় তো কি? কুয়াশা আব্বাজানের এই পরিবর্তন এনে দিয়েছে। আচ্ছা কলিম, লোকটা কে?
জানি না। তবে এইটুকু বুঝেছি অদ্ভুত বুদ্ধিমান এবং দুর্দান্ত সাহসী এই লোকটার মধ্যে আগুন আছে। এই মহান আগুনের কাছে এলে সবার কালিমা ঘুচে যায়। এমন মানুষ আর দেখিনি আমি।
.
আনিস চৌধুরীর বাড়িতে বিকেল বেলায় চায়ের আসর বসেছে। শহীদ, কামাল, মি. সিম্পসন, রীণা সবাই গোল হয়ে বসেছে সামনের লাউঞ্জে। সবুজ ঘাসের ওপর পরিপাটি করে খানকয়েক চেয়ার আর ছোটো ছোটো তেপায়া সাজানো।
আনিস চৌধুরী এসে বসলেন একটা খালি চেয়ারে। শহীদকে লক্ষ্য করে বললেন, মনে হচ্ছে এই কয়টা দিন যেন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে উঠলাম। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে বিশ্বাসই হতে চায় না সব কিছু।
সত্যি বলেছেন। ঠিক যেন একটা দুঃস্বপ্ন!
কামাল শহীদের দিকে চেয়ে বললো, কয়েকটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না কিছুতেই। এ কদিন ব্যস্ততার মধ্যে জিজ্ঞেস করবার সময়ই পাইনি। একটু বুঝিয়ে দে ভাই।
জিজ্ঞেস কর, আমি যতটা বুঝেছি বলবো।
মিশরীয় নর্তকীকে খুন করা হলো কেন?
তার কাছে মিশরের পিরামিডের নিচের একটা গুপ্তধনের নক্সা ছিলো, তাই।
গুপ্তধনের নক্সা! পিরামিডের নিচে…
হ্যাঁ, এই নর্তকী ছিলো মিশর রাজকুমারীর বাল্য-সখী। রাজ-অন্তঃপুরে ছিলো তার অবাধ যাতায়াত। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এই জেবা ফারাহ সুযোগ বুঝে একদিন রাজবাড়ি থেকে নক্সাটা চুরি করলো। মহামূল্যবান ধন-রত্ন মণি-মাণিক্য সেই পিরামিডের তলায় রক্ষিত আছে কয়েক হাজার বছর ধরে, রাজ্যের দুর্দিনে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে। নক্সা চুরির কথা জানাজানি হলে পরে খুব.চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো রাজ অন্তঃপুরে। যে কয়েকজনকে সন্দেহ করে নজরবন্দী রাখা হলো জেবাও তাদের মধ্যে একজন। মিশর সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠলো এদের বিরুদ্ধে। রাজরোষ এড়াবার জন্যে নানান ছলে জেবাকে পালিয়ে আসতে হয় তুরস্কে। সেখানেও শান্তি নেই, মনের মধ্যে সন্দেহ-মিশরীয় গুপ্তচর নিশ্চয়ই লেগে আছে পেছনে। তাই সারা মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়া, ইরান, ইরাক, টার্কি আজ এখানে কাল ওখানে নাচ দেখিয়ে বেড়াতে লাগলো জেবা ফারাহ। সেই সূত্রেই লাহোরে এসে উপস্থিত হলো একদিন সে। এবং সেখানেই পড়লো নেসারের খপ্পরে।