কিছুক্ষণ পায়চারি করবার পর চৌধুরী সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো নেসার আহমেদ, তারপর বললো, আমার এই অনুচরটি আপনার কন্যার প্রতি অত্যন্ত আসক্তি হয়ে পড়েছে। আজ দুপুরে একবার ঢুকে পড়েছিল ওর ঘরে প্রেম নিবেদন করতে বহুকষ্টে ওকে ঠেকানো হয়েছে। আমার প্রিয় করেদের নজর দেয়া জিনিস আমি ভোগ করতে চাই না, তাই ওকেই ডেকে পাঠালাম।
কোরবান আলীর গোটা কতক নোংরা দাঁত বেরিয়ে পড়লো খুশিতে। কোনও মতে সেগুলোকে চেপে সবিনয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো সে।
পর্দাটা সরিয়ে ফেলে।
সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখলো। নেসারের পিছনে যেটা এতক্ষণ দেয়াল মনে হয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বা ধারের দেয়ালের ভেতর। সামনের বেশ কিছুটা জায়গা খোলা। এবং ঘরটার অপর প্রান্তে ঠিক শহীদদের মতো হাত দুটো পিছমোড়া করে দরজার কড়ার সাথে বাঁধা রয়েছে রীণা চৌধুরী। বাবার সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো রীণা। বোঝা গেল কোনও কথাই ওর আগোচরে নেই। একটা অসহায় মেয়ের ওপর এতো বড় একটা পাশবিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে তার পিতার চোখের সামনে; শহীদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সমস্ত শক্তি দিয়ে সে চেষ্টা করলো কয়েকবার হাতের বাঁধনটা ছিঁড়ে ফেলতে। তাতে ফল কিছুই হলো না, বাঁধন আরও শক্ত হয়ে বসলো। ওর ব্যর্থ প্রয়াস নেসার চেয়ে দেখলো, তারপর মৃদু হেসে কোরবান আলীকে বললো, কোরবান তোমার কাজ তুমি কর।
লোভাতুর কুকুরের মতো ছুটে গেল কোরবান আলী রীণার পাশে। শাড়ির আঁচলটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়ে একটানে রাউজটা ছিঁড়ে দুটুকরা করে ফেললো।
রীণার দেহ থেকে শাড়িটা খুলে মাটিতে ফেলে দিলো কোরবান আলী। রইলো কেবল বক্ষাবরণ আর পেটিকোটটা। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস পড়ছে উন্মত্ত কোরবানের।
রাগে দুঃখে চৌধুরী সাহেবের চোখে জল এলো। বিড় বিড় করে কেবল উচ্চারণ করলেন, আল্লা! তুমি আমার মেয়েকে বাঁচাও?
ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করলো কলিম। বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো সে কোরবান আলীর ওপর। পেছন দিকে ফিরে ছিলো কোরবান আলী। অপ্রস্তুত কোরবান আলীর ঝাঁকড়া চুলের মুঠি ধরে এক টানে তাকে চিৎ করে মাটিতে শুইয়ে ফেললো কলিম। তারপর জুতো পায়ে দমাদম ওর নাকে মুখে লাথি মারতে থাকলো। কয়েকটা লাথি খাবার পর উপুড় হয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢাকবার চেষ্টা করলো কোরবান আলী, তখন নিষ্ঠুরভাবে কলিম ওর শরীরের যেখানে সেখানে লাথি মারতে থাকলো।
হঠাৎ কলিমের একটা পা ধরে হেচকা টান মারলো কোরবান আলী। পাকা মেঝের ওপর পড়ে কলিমের মাথাটা ভয়ানকভাবে ঠুকে গেল। দরদর করে রক্ত বেরিয়ে পড়লো আগের ক্ষত জায়গাটা থেকে। ততক্ষণে টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে কোরবান। দেখা গেল, নির্মম লাথির চোটে একটা চোখ গলে বেরিয়ে পড়েছে কোটর থেকে। সে ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে নেসার আহমেদ ছাড়া বাকি সবাই শিউরে উঠলো। অল্পক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে হুড়মুড় করে পড়ে গেল কোরবান আলী রীণার পায়ের কাছে।
ঘটনাটা ঘটে যেতে দশ সেকেণ্ডের বেশি সময় লাগলো না। নেসার আহমেদ ততক্ষণে রিভলভার তুলে নিয়েছে হাতে। গর্জন করে উঠলো উত্তেজিত নেসার, কুকুরের মতো গুলি করে মারবো তোকে শয়তান! মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে নে।
কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা লাঠির আঘাতে নেসারের হাত থেকে রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল দূরে। চমকে ফিরে চাইলো নেসার। দেখলো ডান ধারের খোলা জানালা দিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে কুয়াশা। তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মিশমিশে কালো প্রকাণ্ড এক গরিলা!
প্যান্টের সাথে ঝোলানো একটা খাপ থেকে একটানে একটা ঝকঝকে ছোরা বের করলো নেসার।
এতদিনে তোমায় সামনে পেয়েছি কুয়াশা! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন।
ছোরা হাতে লাফিয়ে পড়লো নেসার কুয়াশার ওপর।
বিদ্যুৎ গতিতে সরে গেল কুয়াশা একপাশে। আর নেসার আহমেদ সোজা গিয়ে পড়লো গোগীর কবলে। লম্বা হাত দিয়ে প্রথমেই নেসারের নাক মুখের ওপর একটা প্রচণ্ড থাবড়া বসালো গরিলাটা। পড়ে যাচ্ছিলো নেসার আহমেদ, কিন্তু চট করে ধরে তাকে মাথার ওপর তুলে নিলো অসীম শক্তিশালী গোগী, তারপর ছুঁড়ে মারলো দূরের দেয়াল টার দিকে। দড়াম করে দেয়ালের সাত ফুট উঁচুতে একটা কাঁচের ফ্রেমে আঁটা ছবির ওপর গিয়ে পড়লো নেসারের দেহটা প্রবল বেগে, তারপর ভাঙা কাঁচের সাথে একই সঙ্গে পড়লো একেবারে সটান মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে। আর উঠলো না।
ওয়েল ডান্ গোগী! ওয়েল ডান! এখন ভালো মানুষের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো তো!
বলতে বলতে কুয়াশা এসে দাঁড়ালো হাত বাঁধা অবস্থায় শহীদ, কামাল, মি. চৌধুরী আর মি. সিম্পসনের সামনে।
ছিঃ ছিঃ? এতগুলো বুদ্ধিমান লোক ছাগলের মতো করে বাঁধা কেন? শহীদ খান, তুমিও যে এমন বোকামী করবে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। যাক, বেশি কথার সময় নেই, অনেক কাজ পড়ে রয়েছে, আমি চলে গেলে কলিম তোমাদের বাঁধন খুলে দেবে। ততক্ষণ একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো।
নেসারের সংজ্ঞাহীন দেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর নেসার আহমেদের গলায় বাঁধা একটা চারকোণা তাবিজ এক টানে ছিঁড়ে নিলো।
এদিকে কলিম ততক্ষণে ধীরে ধীরে উঠে বসেছে। অর্থহীন দৃষ্টিতে একবার চারদিকে চেয়ে দেখলো, তারপর নেসারের ছুরিটা দিয়ে রীণার বাঁধন কেটে দিলো। মাটি থেকে কুড়িয়ে রীণার শাড়িটা ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে এলো শহীদের দিকে।