রাগে গজ গজ করে পরাজিত জুয়াড়ীরা। কিছুক্ষণ পর আরও কয়েকজন এসে যোগ দিলো খেলায়। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া আর মদের বোতলের টুংটাং শব্দের সাথে মাতাল জুয়াড়ীদের মত্ত কোলাহল একটা নারকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ঘরটায়। পরস্পর পরস্পরের প্রতি অবাধে ম-কার ব-কার এবং শ-কার তুলে অশ্লীল মন্তব্য এবং গালাগালি চলেছে। ভদ্রতা সৌজন্যের প্রশ্ন এখানে বাতুলতা মাত্র।
এ সময় মোতিয়া ঢুকলো ঘরে। হৈ হৈ করে উঠলো সবাই। কেউ বললো, আও মেরী জান! কেউবা–জানে জিগ্যর, আও ইধার পেয়ারী।
কারও কথায় কর্ণপাত না করে গভীরভাবে মোতিয়া বললো, সর্দার মেহমানদের ওপরে তলব করেছেন।
কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই কয়েকজন লোক বাঘের মতন লাফিয়ে পড়লো শহীদ, কামাল, সিম্পসন আর চৌধুরী সাহেবের ওপর। প্রস্তুত হবার জন্যে এক মুহূর্ত সময় পেলো না ওরা। শহীদ প্রথম আক্রমণকারীর প্রায় নাকের ওপর একটা ঘুষি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু পেছন থেকে অপর একজন সাপটে ধরে ফেললো ওকে এবং এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে রিভলবার বের করে নিলো। বাকি দুজন এগিয়ে এসে হাত দুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো ওর। ততক্ষণে বাকি তিনজনেরও একই অবস্থা হয়েছে।
শহীদ বুঝতে পারলো এতক্ষণ এ ঘরের সব কটা লোক তাদের না চিনতে পারার ভান করেছিল মাত্র। তাদের পরিচয় কারো কাছেই অজানা ছিলো না। সবাই কেবল সর্দারের হুকুমের অপেক্ষা করছিল। তবে যে দুদিন আগে জুম্মান মিস্ত্রি ওকে এই দলে ভর্তি করিয়ে দিলো সেটাও কি এদের অভিনয়? আজ ওকে দেখা গেল না কেন? সেও কি এদের হাতে বন্দী হয়েছে?
দোতলার একটা ঘরে নিয়ে আসা হলো বন্দীদের।
একটা ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে চুরুট টানছিল নেসার আহমেদ চোখ বন্ধ করে। পায়ের আওয়াজ শুনে ধীরে চোখ মেললো সে। মৃদু হেসে বললো, আসুন, আসুন, স্বাগতম। নেসার আহমেদকে বন্দী করতে এসেছিলেন, কিন্তু ভাগ্যের কি বিপরীত লিখন–উল্টো আপনারাই তার হাতে হলেন বন্দী। নিজেদের ছেলেমানুষী বুদ্ধিতে আমাকেও কচি খোকা ঠাউরে আপনারা মস্ত ভুল করেছেন, মি. সিম্পসন।
ততক্ষণে একটা মোটা রশি দিয়ে চারজনকেই শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। একটা মস্ত দরজার লোহার কড়ার সাথে।
আমাদের নিয়ে কী করতে চাও তুমি বদমাশ? মি. সিম্পসন রাগতঃ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
মুখের ভাষাটাকে আর একটু মার্জিত করতে শিখুন, মি. সিম্পসন। সৌজন্য প্রকাশ করতে পয়সা লাগে না। যাকগে, আপনাদের তিনজন, অর্থাৎ আপনি, মি. শহীদ এবং মি. কামালকে আমি এই প্রথম বারের মতো মৃদু শাস্তি দিয়েই ছেড়ে দেবো, মানে ভবিষ্যতে আমার পেছনে লাগবার দুঃসাহস আর যেন না হয়। আপনাদের গোটা শরীর থেকে মাত্র আধ ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা আমি কেটে বাদ দিয়ে দেবো। যাতে খাওয়া দাওয়ার কোনো রকম অসুবিধা না হয় সেজন্যে ভাবছি বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুল থেকে কথা আমার মাথায় আসছে না।
এ ধরনের হুমকি আমি বহুবার, বহু চোর ছাচোরের মুখে শুনেছি নেসার। ওতে আমাকে কাবু করতে পারবে না। তুমি জানো, আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করলে তোমার
কচু হবে। একগাদা ভীতু পুলিস নিয়ে এসে বাড়ি ঘেরাও করেই মনে করেছেন নেসার আহমেদ ধরা পড়ে গেল। যাকগে, বৃথা বাক্যব্যয়ের সময় আমার নেই। আমার যে কথা সেই কাজ। তার প্রমাণ পাবেন অল্পক্ষণ পরেই। তবে আপনাদের মধ্যে থেকে যদি কেউ আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবে আমি বিনা শাস্তিতে তাকে এই প্রথম বারের জন্যে মুক্তি দেবো। বলুন আপনাদের কারও কিছু বলবার আছে?
চৌধুরী সাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, নেসার আহমেদ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললো, আপনার কোনও কথা আমি শুনতে চাই না, দুবার আপনাকে সুযোগ দিয়েছি, তৃতীয় বারে আপনার ক্ষমা নেই। আমি শহীদ, কামাল আর সিম্পসনকে জিজ্ঞেস করছি, কারও কিছু বলবার আছে?
কেউ কোনও উত্তর দিলো না। এবার এক এক করে নাম ধরে ডাকলো নেসার, মি. সিম্পসন?
তিনি কোনও উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলেন, যেন শুনতেই পাচ্ছেন না কিছু।
মি. শহীদ?
আমি তোমাকে ঘৃণা করি। অতি নীচ পাষণ্ড তুমি। তোমাকে এছাড়া আর কিছুই বলবার নেই।
মি. কামাল?
কামাল কোনও উত্তর দিলো না, কেবল কটমট করে নেসারের দিকে চেয়ে রইলো।
বেশ। একটা ঝামেলা গেল। এবার বলুন, মি. চৌধুরী, চাবিটা এনেছেন?
চাবিটা আমার কাছে নেই। বাবা আমাকে ঐ চাবি দিয়ে যাননি।
বিশ্বাস করলাম না আপনার কথা। তাহলে চাবি আপনি দিচ্ছেন না?
নেই তো সেটা আমার কাছে।
ভাল কথা। আমার দ্বিতীয় চিঠিতে কি লেখা ছিলো নিশ্চয়ই পরিষ্কার মনে আছে আপনার। আমার আদেশ উপেক্ষা করে এর পরেও আপনি পুলিসের সাহায্য নিয়েছেন; এমন কি আজ আমার আস্তানায় উপস্থিত হয়েছেন আমাকে গ্রেপ্তার করে মেয়েকে উদ্ধার করবেন বলে।
আমি সেজন্যে মাফ চাইছি নেসার আহমেদ।
আপনি সে সীমা লঙ্ঘন করে গেছেন অনেক আগেই মি. চৌধুরী। এখন বৃথা মাফ চেয়ে নিজেকে ছোট করবেন না। আমার কথার নড়চড় হবে না। আপনার স্পর্ধার শাস্তি হিসেবে অল্পক্ষণ পরেই আপনার চোখের সামনে আপনার কন্যার সর্বনাশ করা হবে। ঐখানে বাঁধা অবস্থায় ছটফট করবেন আপনি, তাছাড়া আর কিছুই করবার উপায় থাকবে না আপনার।
নিভে যাওয়া চুরুটটা জ্বালিয়ে নিয়ে নেসার আহমেদ কয়েকবার পায়চারি করলো ঘরের মধ্যে। তারপর পাঞ্জাবী ভাষায় অনুচরদের কি যেন বললো। তার মধ্যে কোরবান আলী কথাটা ছাড়া আর কিছুই বোঝা গেল না। সবাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অল্পক্ষণ পরই নেসার আহমেদের প্রধান অনুচর কোরবান আলী এসে ঢুকলো ঘরে। লম্বা প্রায় সাড়ে ছফুট হবে, এবং সেই তুলনায় প্রস্থও প্রকাণ্ড। পেটা শরীরে পেশীগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এক মাথা ঝাঁকড়া চুল এবং কপালের নিচে দুটো জ্বলজ্বলে লাল চোখ। ঘরে ঢুকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো কোরবান।