এমনি সময় ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলো মোতিয়া। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করে ডাকলো, কোরবান!
ঠিক স্প্রিং-এর মতো তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো কোরবান আলী।
এক্ষুণি বেরোও ঘর থেকে, নাহলে আমি সর্দারকে ডাকবো।
তীব্র জ্বালাময় দৃষ্টিতে একবার মোতিয়ার দিকে চাইলো কোরবান আলী, তারপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাবার সময় চাপাস্বরে বলে গেল, এর প্রতিশোধ নেবো আমি। প্রস্তুত থেকো।
বিছানা থেকে উঠে রীণা মাটি থেকে কাপড়টা তুলে পরে নিলো। তারপর বললো, তুমি আমাকে বাঁচালে ভাই।
তাই মনে হচ্ছে আপাততঃ, কিন্তু রাত দশটার সময় তোমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সর্দারের শয়নকক্ষে দিয়ে আসতে হবে এই আমাকেই। তিনি আগে তোমাকে ধন্য করবেন তারপর তাঁর চেলা-চামুণ্ডারা।
.
চলে গেল মোতিয়া। বিছানার ওপর বসে পড়লো রীণা। বড় অসহায় লাগলো নিজেকে তার। মেয়েমানুষের জীবনটা কী? এই একটু আগেই একজন তার সর্বনাশ করতে বসেছিল, তাকে ঠেকাবার কোনও শক্তি ছিলো না তার। এ বিপদ কেটে গেল ঠিকই। কিন্তু রাতে? এক দস্যুর অঙ্গশায়িনী হতে হবে তাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। হঠাৎ কান্না পেলো রীণার। বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে ফেললো সে। মনে পড়লো কলিমকে। এই বুঝি তাদের স্বপ্নের সুখের সংসার? কোথায় তুমি কলিম? তোমার কাছে প্রাণ মন সঁপে একসাথে বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে। আমাকে একলা এই বিপদে ফেলে কোথায় রইলে তুমি এখন। বাঁচাও আমাকে কলিম! এই সর্বনাশ থেকে বাঁচাও!
.
জ্ঞান ফিরে এলো কলিমের ঠিক দুঘন্টা পর। কে যেন তার চোখে মুখে জল ছিটাচ্ছে। উঠে বসতেই চাঁদের আলোয় দেখতে পেলো ধানমণ্ডি লেকের ধারের সেই খোঁড়া ভদ্রলোককে।
আপনি? আপনি এখানে!
রীণা কোথায় কলিম? এলো না? তোমাকে এমন করে মারলেই বা কে? পড়ে গিয়েছিলে?
এ প্রশ্নে লিমের ঘোর কেটে গেল। সব কথা মনে পড়তেই একবার চারদিকে চাইলো সে, তারর সটান উঠে দাঁড়ালো।
কোথায় চললে?
পাঁচিল টপকে দুজন নেমেছিলাম এই মাঠে কিছু আগে। হঠাৎ কয়েকজন লোক আমাকে আক্রমণ করলো। বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আঘাত খেয়ে। আর কিছু মনে নেই আমার। কিন্তু রীণা? রীণা কোথায় গেল?
যা ভেবেছিলাম, তাই হয়েছে দেখছি। আমার পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে নেসার তার কাজ হাসিল করে নিয়েছে।
আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
চলো তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবো। এই মাঠে রীণাকে খুজলে পাবে না। তাছাড়া তোমার এখন চিকিৎসার দরকার। তোমার মাথা থেকে এখনও রক্ত পড়া বন্ধ হয়নি। চলো দেরি করো না।
অদ্ভুত স্নেহশীল এই কণ্ঠ। যেন কতদিনের বন্ধু, এমনি দাবি এর কথায়। তাই উপেক্ষা করা যায় না এর নুরোধ। খোঁড়া লোকটার পিছন পিছন গিয়ে একটা কালো গাড়িতে উঠলো কলিম।
ভোর রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল কলিমের। মিষ্টি একটা বাজনার শব্দ এলো কানে। পাশের ঘর থেকে আসছে শব্দটা। নিজের অজান্তেই উঠে পড়লো কলিম বিছানা থেকে। ভৈরো রাগে সুগম্ভীর আলাপ করছে কে যেন সরোদে। অপূর্ব সুরমূর্ঘনায় অভিভূত হয়ে পড়লো কলিম। এগিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের ভারী পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে তাকাতেই কিছু একটা দেখে আঁতকে উঠলো কলিম। ভয়ে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠলো ওর। শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে একটা শিরশিরে আতঙ্কের স্রোত বয়ে গেল।…
আবছা আলো অন্ধকারে একটা বাঘের চামড়ার ওপর ধ্যানাসনে বসে সরোদ বাজাচ্ছে খোঁড়া লোকটা–আর তার সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মাটিতে বসে আছেবিকট দর্শন প্রকাও একটা গরিলা।
সন্তর্পণে নিজের বিছানায় ফিরে এলো কলিম।
বাকি রাতটুকু আর ঘুম এলো না তার চোখে। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত মিষ্টি বাজনাটা বেজেই চললো।
.
০৭.
রাত আটটা। নতুন ঢাকার নির্জন মালিবাগ অঞ্চলের ইন্দ্রপুরী এলাকায় যেন লোক চলাচল একটু অস্বাভাবিক রকমের বেশি বলে মনে হচ্ছে। হরেক রকম লোক বিভিন্ন পোশাক পরিচ্ছদ পরে যাতায়াত করছে একটা মস্ত পুরোনো জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে।
আর সেই জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে স্বল্পালোকিত একটা মাঝারি আকারের ঘরে চলেছে ফ্লাশের আড়া। ঝনঝন আধুলি পড়ছে বোর্ড ফী; তারপর তাস বাটা হলে
আওয়াজ আসছে, এক রুপেয়া।
পাশ।
এক।
এক।
দো!
দো রুপেয়া।
পাঁচ।
পাশ।
বিশ রুপেয়া?
লে লো বিশ!
শো?
ছে সাত আঠ কা রান।
ছোডড়া বেটা, ইয়ে লো রানিং ফ্লাশ! হাহাহা…। আবার ঝনঝন পড়ছে বোর্ড।
দলের একজন নতুন স্যাঙাৎ জিতে নিয়ে যাচ্ছে প্রায় বেশির ভাগ বোর্ডই। সুদর্শন এই নবনিযুক্ত যুবকের পেছনে চেলাচামুণ্ডা জুটে গেছে ইতিমধ্যেই; হৈ হৈ করছে তাকে ঘিরে। এমন ভাগ্যবান সচরাচর মেলে না। ভালো বিলাতি বোতল নিশ্চয়ই মিলবে আজ এর পিছনে থাকলে।
এই নতুন লোকটি আমাদের শহীদ ছাড়া আর কেউ নয়। মি. সিম্পসন, চৌধুরী সাহেব আর কামালও আছে ছদ্মবেশে এই জুয়োর আড্ডায় অন্য সবার সাথে মিশে।
খোলোয়াড়দের মধ্যে মাতব্বর গোছের একজন অতিরিক্ত চটে গেছে নতুন মক্কেলের উপর। এ কেমন বেয়াদবী? নতুন ঢুকেই পুরোনোদের হারিয়ে দিচ্ছে। কেমন ধারা শরাফতী এটা? সে বলেই বসলো, বহোত চালু মালুম হোতে হো ভাইয়া। যারা সোঁচ সামাকে চ্যলন।
নতুন স্যাঙাৎ খাশ ঢাকাই ভাষায় বললো, আরে চুপ কইরা থাক। তেরীবেরী করিছ না। হারবার আইছত হাইরা বাইত্ যাগা।