- বইয়ের নামঃ পিরামিডের গুপ্তধন ১
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ কুয়াশা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাকশন
পিরামিডের গুপ্তধন ১
কুয়াশা ৩ (ভলিউম ১)
০১.
গাঢ় হয়ে এসেছে বর্ষার সন্ধ্যা। বাইরে ঝমঝম অবিরাম বৃষ্টি, আর সেই সাথে প্রচণ্ড ঝড়। মাঝে মাঝে কাঁচের শার্শি দিয়ে বিদ্যুতের তীব্র ঝলসানি ঘরের সবাইকে সচকিত করে দিচ্ছে, পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে দূরে কোথাও। হু হু করে দমকা হাওয়া ছুটে এসে জানালার কবাট ধরে ঝাঁকাচ্ছে। ভিতরে আসবার জন্যে চেষ্টা করছে যেন ভয়ঙ্কর প্রেতলোকের কোনও অতৃপ্ত আত্ম। মহা তাণ্ডবলীলা চলছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে।
শহীদের ছোটো একতলা বাড়ির ড্রইংরুমে মুখোমুখি বসে শহীদ, কামাল আর মহুয়া গল্প করছে। কামালের কি একটা হাসির কথায় কপট রাগ করে মহুয়া কামালকে মারতে যাবে–হঠাৎ কি দেখে যেন উঃ করে আর্তনাদ করে উঠলো ভয়ে। সবাই ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইলো। আঙুল দিয়ে দরজার দিকে কি একটা দেখিয়ে মহুয়া শুধু বললো ভূত! তারপরই অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো সোফার ওপর। সবাই একসাথে চাইলো দরজার দিকে। একটা ভয়ঙ্কর দর্শন প্রকাণ্ড গরিলা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মধ্যে।
শহীদ একবার চোখ কচলালো, স্বপ্ন না সত্যি? আফ্রিকা জঙ্গলের এই ভীষণ হিংস্র জন্তু, কি করে এলো তার ঘরে? ঝর ঝর করে তার গা বেয়ে বৃষ্টির জল ঝরে কার্পেটের ওপর, পড়ছে। কিন্তু এক সেকেও মাত্র। তারপরই এক ঝটকায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো শহীদ। শহীদ উঠে দাঁড়াতেই এক পা এগিয়ে এলো গরিলাটা। শহীদের সাথে রিভলভার নেই। শোবার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে আছে সেটা। দমাদম করে দুবার নিজের বুকের ওপর চাপড় বসালো গরিলাটা। যুদ্ধ ঘোষণার ইঙ্গিত। এক মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে নিলো শহীদ। একটা কাঠের চেয়ার তুলে নিলো ওকে প্রতিরোধ করবার জন্যে।
এমন সময় গফুর এসে ঢুকলো চা নিয়ে। ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত ভয়ঙ্কর গরিলা দেখে সে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল-হাত থেকে ট্রে-টা মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে কাপ তস্তরী ভেঙে গেল সব। প্রথমে সে পালাবার জন্যে দুপা পিছিয়ে গেল, কিন্তু কি ভেবে থেমে পড়লো আবার। তারপর ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো জন্তুটার ওপর। গরিলাটা এক পা-ও নড়লো না। শুধু বাঁ হাতটা দিয়ে অবলীলাক্রমে গফুরকে ঝেড়ে ফেলে দিলো শরীরের ওপর থেকে। গফুরের প্রকাণ্ড দেহ ছিটকে গিয়ে পড়লো দেয়ালের গা ঘেঁষে রাখা শো-কেসের কাঁচের ওপর, তারপর সটান মাটিতে।
এবার, একলাফে জন্তুটা চলে গেল গফুরের পাশে। কামালও একলাফে সোফা, টপকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। শহীদ এগিয়ে গেল কাঠের চেয়ারটা মাথার ওপর তুলে গরিলাটার দিকে। ঠিক সেই সময় ঘরের বাইরে থেকে বহু গম্ভীর কণ্ঠে কে যেন ডাকলো জন্তুটাকে, গোগী, কাম হিয়ার।
তারপর পর্দাটা তুলে ঘরে এসে ঢুকলো কালো আলখাল্লা পরা একজন লোক। খোঁড়া লোকটা। দুই বগলে দুটো ক্যাচের ওপর ভর করে এগিয়ে এলো লোকটা ঘরের মধ্যে। চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে জন্তুটাকে আবার বললো–গেট আউট, গোগী! নিতান্ত অনুগত নৃত্যের মতো সেই ভয়ঙ্কর জন্তুটা থপ থপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমাকে চিনতে পারছে না শহীদ? লোকটা বললো শহীদের দিকে ফিরে!
কুয়াশা! কামালের মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেল কথাটা।
শহীদও বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ কুয়াশার মুখের দিকে। তারপর বললো, তুমি! তুমি বেঁচে আছে!
যে লোককে আফ্রিকার লিপোপো নদীতে ডুবে যেতে দেখেছে এক বছর আগে, যাকে ঘিরে সেই ভয়ঙ্কর নদীর কুমীরগুলোকে কিলবিল করে উঠতে দেখেছে নিজ চোখে, সে বেঁচে আছে কি করে বিশ্বাস করা যায়?
নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো কুয়াশা, হ্যা! বেঁচে আছি! এবং আজ দুটো সত্যি কথা শুনিয়ে যাবার জন্যেই আমার আসা। একটা কথা হচ্ছে, তুমি কাপুরুষ এবং দ্বিতীয় কথা, তুমি বিশ্বাসঘাতক, কৃতঘ্ন বেঈমান। তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে আমি কি না করেছি। কতো বড় বিপদ মাথায় নিয়ে আফ্রিকা গিয়েছি তোমার পিছন পিছন, নিজের জীবন বিপন্ন করে কতবার তোমার জীবন রক্ষা করেছি। ছি ছি ছি ছি, শহীদ, সেই তুমি আমাকে কুমীরের মুখে ফেলে পালিয়ে এলে লঞ্চ ছেড়ে দিয়ে! বিষাক্ত ওষুধ ছড়িয়ে কুমীরের হাত থেকে জীবনটা রক্ষা করতে পেরেছি, কিন্তু পা-টা রক্ষা করতে পারিনি। কাটা পা নিয়ে বহু কষ্টে যখন নদীর অপর পারে উঠেছি, তখনও তোমরা আমার চোখের আড়ালে যাওনি। অসহায় আমি চিৎকার করে ডেকেছি তোমাকে, গায়ের জামা খুলে নিয়ে উড়িয়েছি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, তুমি বলতে চাও আমায় দেখতে পাওনি, কিংবা আমার ডাক শোননি? আমি হলপ করে বলতে পারি, তুমি, দেখেছো আমাকে, কিন্তু জংলীদের ভয়ে এগিয়ে আসতে সাহস পাওনি। একবার লঞ্চ থামিয়েও আবার না দেখতে পাওয়ার ভান করে পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করেছে।
শহীদ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললো, কিন্তু সত্যি বলছি বিশ্বাস করো আমাকে
তোমাকে বিশ্বাস করবো আবার? বগম্ভীর কণ্ঠে শহীদকে বাধা দিয়ে বললো কুয়াশা, আর অভিনয় করবার চেষ্টা করো না শহীদ। ছি, ছি তোমার লজ্জা করে না? আর বেশি কথার প্রয়োজন নেই, মহুয়া বোধহয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি চললাম, আর যাওয়ার আগে আরেকবার বলে যাচ্ছি, তুমি কাপুরুষ, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক এবং নেমকহারাম।