চিয়ার আপ গোগী।
কুয়াশা একটু হেসে আস্তে গলায় আদর জানালো গোগীকে। ইশারা করতেই গোগী থপ থপ পায়ে এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা প্রাচীর-মুখ খুলে দিলো। খুলে দিতেই এক ঝলক বিদ্যুৎ গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্ধকারে। প্রাচীর পথ অস্পষ্ট আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো। অন্ধকার দেয়াল পথে ঝাঁপ দেয়ার মুখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে চাইলে কুয়াশা। গলা ততক্ষণে ধূমপানের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছে। পকেটে হাত দিতেই সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে উঠে এলো ছোটো একটি চিরকুট। চিরকুটে কায়রো নগরের জনৈক অভিজাত যুবকের নাম ও ঠিকানা লেখা। সব ঘটনা মনে। পড়লো কুয়াশার। সেদিন ভোর বেলা দীবা ফারাহকে উদ্ধার করে সে লঞ্চে ফিরে গিয়েছিল। দুপুর পর্যন্ত দীবাকে সে কোনো কথা বলতে দেয়নি। বলেছে, আগে বিশ্রাম করো। পানি তৈরি আছে, স্নান সেরে নাও। লাঞ্চের পর কথাবার্তা হবে।
দীবা কথা বলার জন্য উদগ্রীব ছিলো। কিন্তু কুয়াশার কথা নিঃশব্দে সে পালন করেছিল। দুপুরের খাওয়ার পর দুজন দুটি চেয়ারে কেবিনের বারান্দায় বসেছিল। দীবা তার সংঘাত ও বেদনাজর্জরিত জীবনের সব কাহিনী খুলে বলেছিল।
জেবা ও দীবার পরিবার কায়রো নগরের অত্যন্ত অভিজাত এক পরিবার। জেবা রাজকুমারী আয়িদার অন্তরঙ্গ সখী রূপে গণ্য হবার পর এই পরিবারের সম্মান আরো বেড়ে গেল। কিন্তু সুখ, সম্মান প্রতিপত্তি সবই বুঝি নীল নদের জোয়ার ভাটার মতো। সাময়িক। এই আছে, এই নেই। শীঘ্রই জেবা ও দীবাদের পরিবারে দুর্যোগ ঘনিয়ে এলো। জেবা ছিলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তার উচ্চাকাঙ্খা পরিণত হলে লোতে এবং লাভের বশবর্তী হয়ে সে রাজকুমারী আয়িদার নক্সা চুরি করে মিশর ত্যাগ করলো। জেবাকে অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারের জন্য রাজ পরিবার থেকে বিশেষ এক শ্রেণীর গোয়েন্দা পুলিস নিয়োজিত হলো। দেশে বিদেশে চললো তৎপরতা। কেবল তাই নয়। দীবা ও তার বৃদ্ধ পিতার উপরও অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হলো। কৌশলে বৃদ্ধ পিতার জমিদারী ও খেতাব বাজেয়াপ্ত করা হলো। বৃদ্ধ পিতা ভগ্ন মনোরথ হয়ে আত্মহত্যা করলেন। দীবাও পিতার সঙ্গেই আত্মহত্যা করতো। করেনি একটি মাত্র আশা ও বিশ্বাসে। সেই আশা ও বিশ্বাসের নাম মুজাদ্দিদ করীম, কায়রো নগরীর এক অভিজাত যুবক।
দীবা তার কাহিনী বলতে বলতে থেমে গিয়েছিল। বলেছিল, গ্রীক দেবতা এপোলোর মূর্তি দেখেছো তুমি?
কুয়াশা বলেছিল, দেখেছি।
তাহলে আর করীমের রূপ বর্ণনা করার প্রয়োজন হয় না। করীম গ্রীক দেবতা এপোলোর মতোই সুন্দর। সে আমাকে ভালবাসত আমি তাকে ভালবাসতাম। আমরা দূজন সুখের নীড় বাঁধবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু
বলতে বলতে দীবার গলার স্বর কান্নায় ভারি হয়ে এসেছিল, সেই নক্সা চুরির পর করামও আমাকে ত্যাগ করলো। সে জানিয়েছে তার বাবা-মা একটি নিঃস্ব পরিবারের মেয়েকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। শুনেছি কোটিপতি আল গাফরানের মেয়ে নাঈমা বর্তমানে তার বাগদত্তা।
এজন্যেই তুমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে?
হ্যাঁ। বেঁচে থেকে আমার কি লাভ বলো? আমার অর্থ নেই, পারিবারিক সম্মান নেই…ভালবাসার মানুষটি পর্যন্ত আমাকে পরিত্যাগ করলো।
কুয়াশা কথা বলেনি। শুধু দীবাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। অপূর্ব সুন্দরী এক যুবতী। তার নিটোল, লাবণ্যমাখা মুখখানি বেদনায় বিষণ্ণ। যৌবন প্রাচুর্যে ভরা তম্বী দেহলতা হতাশায় ক্লান্ত।
দীবা বললো, আমাকে বাঁচিয়ে কোনো উপকার করোনি তুমি আমাকে একদিন একদিন মরতেই হবে। কুয়াশা একটু হেসেছিল। বলেছিল, যদি করীম তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়।
অসম্ভব।
ধরো সেই অসম্ভব সম্ভব হলো, তখন?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করেছিল দীবা। তারপর আবেগ তপ্ত গলায় বলেছিল, তুমি তো। জানো আমি বাঁচতে চাই। করীম যদি আমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয় তাহলে আমি কি করবো তা বলার দরকার পড়ে না।
চিরকুটটা পকেটে চালান দিলো কুয়াশা। মনে মনে একটু হাসলো, মেয়েদের হৃদয় কি কোমল আর স্নেহ মায়া মমতায় ভরা! এক অসতর্ক টোকায় সরোদের সব কটা তার যেন এক সঙ্গে বেজে উঠলো। টন্ টন করে উঠলো বুকের ভেতরটা। মনে পড়লো। মহুয়ার কথা। মহুয়াই ছিলো তার একমাত্র মেহের বন্ধন। সেই বন্ধন বহুদিন সে ছিন্ন করতে পারেনি। বন্ধন ছিন্ন করতে গেলে হৃদয়ের কোথায় যেন বাজতো। আজ অবশ্য অন্য কথা। আজ সে বেরিয়ে এসেছে অতীত জীবনটা পেছনে ফেলে। বিজ্ঞান গবেষণায় তার প্রচুর অর্থের প্রয়োজন মেটাতেই হবে। যে করে থোক মেটাতে হবে। দীর্ঘ দুমাস এই নক্সার পেছনে অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় করেছে। এখন উদগ্রচিত্তে সে ফল লাভের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু ফল লাভ করার আর কতো দেরি?
হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো কুয়াশা। ডাকলো, গোগী,
গোগী প্রভুর এই ডাকের অর্থ বোঝে। সে যন্ত্রচালিতের ন্যায় ভারি একটা ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। উত্তেজনায় তার গলা দিয়ে ঘড়র ঘড়র শব্দ বেরোচ্ছে।
কুয়াশা কুঠুরী থেকে অন্ধকার দেয়াল পথে নামার আগে টর্চ লাইট ও ডিটেক্টর যন্ত্রটি হাতে নিলো। ঠিক এই সময় কুঠুরির বাইরে কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। শত্রু নয় তো? কুয়াশা একটু হাসলো।
এই যন্ত্রটির বিদ্যুৎ অগ্নি মুহূর্তে যে কোনো ইস্পাতকে গলিয়ে ভস্ম করে দিতে সক্ষম। কোনো মানুষের উপর প্রয়োগ করার জন্য এই যন্ত্রটি কুয়াশা তৈরি করেনি। কিন্তু প্রয়োজন বোধে, উপায় কি, প্রয়োগ করতেই হবে। সে সতর্ক ভাবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। নিঃশব্দে কুঠুরী থেকে বেরিয়ে দেয়াল ঘেঁষা টানা বারান্দায় টর্চের আলো ফেললো। না, কেউ নেই। কিন্তু কেন যেন মনে হলো একটি ছায়া চকিতে দেয়ালের সঙ্গে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল। দৃষ্টি বিভ্রম নয় তো?