জ্ঞানী চিকিৎসকের এই উক্তি এই নক্সার প্রকৃত মালিকানা কার তা কিছু নির্দেশিত করে না, ফলে ফরাসী সরকার ও মিশরীয় সুলতানের মধ্যে এই নক্সাটির স্বত্ব নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘকাল বিবাদের পর আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে এই নক্সার উপর মিশরীয় সুলতানদের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। সেই থেকে নক্সাটি রাজ পরিবারের গুপ্ত কক্ষে রক্ষিত ছিলো। স্বয়ং সুলতান ছাড়া এই নক্সটি, অবস্থান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন সিংহাসনের একমাত্র উত্তরাধীকারিণী রাজকুমারী আয়িদা বানু। সম্ভ্রান্ত বংশীয়া মিশরীয় নর্তকী জেবা ফারাহ্ ছিলো তারই ঘনিষ্ঠতম সহচরী। রাজকুমারীর সঙ্গে সম্পর্ক সূত্রে রাজপ্রসাদে তার ছিলো অবাধ যাতায়াত। একটু আগের সাক্ষাৎকারে রাজকুমারী আয়িদা বানু মি. সিম্পসনকে বলছিলেন, অর্থের উপর জেবার ছিলো দারুণ লোভ। অনেক গুণে সে গুণান্বিত ছিলো। কিন্তু এই লোভ তার সমস্ত গুণাবলী এবং প্রতিভা নষ্ট করে দিয়েছে। জেবাই এই নক্সা রাজপ্রসাদ থেকে চুরি করেছিল মি. সিম্পসন।
মি. সিম্পসন তা জানতেন। তিনি রাজকুমারীর দিকে, সন্ধানী চোখে তাকিয়েছিলেন। দেখেছিলেন রাজকুমারীর অনিন্দ সুন্দর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ক্ষোভ ও রাগের চিহ্ন। রাজকুমারী আরও বলেছিলেন, মিশর রাজ পরিবারের রোষবহ্নি থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যেই নর্তকীর বেশে মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, পাকিস্তান ভ্রমণ করে ফিরছিল জেবা। আমরা জানতাম একদিন না একদিন তাকে মিশরে ফিরতেই হবে। সরকার থেকে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যাতে যে কোনো ছদ্মবেশ ধরে জে মিশরে প্রবেশ করুক, পা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেবাকে গ্রেফতার করা হতো। কিন্তু রাক্ষুসীর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে নক্সা ফিরে পাওয়ার সমস্ত আশা লুপ্ত হয়েছে।
মি, সিম্পসন সব কথাই জানতেন। তিনি দেখলেন রাজকুমারীর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে দারুণ হতাশা। আশ্বাস দিয়ে রাজকুমারীকে তিনি বলেছেন, হতাশ হবেন না হামান্যা রাজকুমারী। জেবার মৃত্যু হয়েছে বটে। কিন্তু নক্সাটি এখনো সম্পূর্ণ অটুট অবস্থায় রয়েছে। এমন কি…
তিনি একটু হাসলেন। বললেন, যার হাতে নক্সাটি রয়েছে সে এখন মিশরেই অবস্থান করছে।
কোথায়?
রাজকুমারী দারুণ উত্তেজনায় আসন ছেড়ে প্রায় উঠে পড়েছিলেন।
মৃদু হাসলেন মি. সিম্পসন। চার হাজার বছরের পুরাতন এই নক্সা এমন রহস্যময় ও বিপজ্জনক ঘটনার সৃষ্টি করবে তা কি জ্ঞানী চিকিৎসক জানতেন?
ভাড়াটে ট্যাক্সি সজোরে ছুটে চলেছে। হাতের সিগারেটটি নিঃশেষিত প্রায়। রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষে মি. সিম্পসন ফিরে চলেছেন হোটলের দিকে বিশ্রাম গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বিশ্রাম কথার কথা মাত্র। মি. সিম্পসন এক মুহূর্তের জন্যেও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। হাতের সিগারেটটি তিনি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কেন যেন খোদবিক্সের মৃত, নিশ্চল চোখ জোড়া তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়লো গুপ্তকক্ষে নেসার আহমেদ ও কুয়াশার সঙ্গে শেষ দেখার কথা। জেবা ফারাহ্র কাছ থেকে নক্সাটি উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল নেসার আহমেদ ও কুয়াশা দুজনেই। কার চেষ্টা সফল হয়েছে কে জানে? তবে সম্ভবতঃ নক্সাটি বর্তমান নেসারের অধিকারে আছে। দুর্দান্ত প্রকৃতির দস্যু নেবার তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে নক্সা নির্দেশিত গুপ্তধন উদ্ধারের কাজ। লুক্কায়িত আছে হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত সাত রাজার ধন। সেই ধনের জন্য কতো খোদাবক্সকে রক্ত দিতে হবে তা একমাত্র ভবিতব্যই বলতে পারে।
ভাড়াটে ট্যাক্সি হোটেলের লনে এসে ঢুকলো। মি. সিম্পসন ড্রাইভারকে আশাতিরিক্ত বকশিস দিলেন। ডাইভার মিগ্রীয় কায়দায় মাথা নিচু করে হাত আন্দোলিত করে সালাম জানিয়ে চলে গেল।
মি. সিম্পসন যখন নিজের ঘরে ঢুকলেন তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে কাছেই একটা মসজিদের দক্ষিণ দিকে মুখ করে নামাজ পড়ছে কয়েকজন মুসল্লি।
.
০৫.
নীল নদের অনতিদূরে গিজে নামক এলাকায় হাজার হাজার বছরের পুরাতন পিরামিডগুলো দণ্ডায়মান। বিশালাকায় প্রস্তর নির্মিত সমাধি মন্দিরগুলো সর্বকালের মানুষের জন্যে বিস্ময়ের বস্তু। বহু ভ্রমণকারী প্রতিদিন এই পিরামিড দর্শনে যায়। আমরা যে তারিখটি উল্লেখ করছি সে তারিখটি ছিলো মিশর সরকারের নির্ধারিত ছুটির দিন। পিরামিড এলাকা সেদিন প্রায় জনশূন্য। সন্ধ্যা অনুমান সাতটায় একজন দীর্ঘকায় পুরুষ মাইকে-রিনোস পিরামিডের দ্বারদেশে উপস্থিত ছিলো। অভ্যাস মতো চারদিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সম্মুখস্থ এক গুহার ভেতর ঢুকলো। সঙ্গে সঙ্গে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। সেই দীর্ঘকায় লোকটি আর কেউ নয়, কুয়াশা। তীব্র টর্চ লাইটের আলোয় পথ চিনে নিতে কষ্ট হলো না। অনতিবিলম্বে কুয়াশা পিরামিডের ভেতর প্রবেশ করলো। চারদিক ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। দুই পাশে খাড়া প্রাচীর। এখানে ওখানে প্রস্তর নির্মিত নানা জীবজন্তুর মূর্তি। কুয়াশা দ্বিতীয় প্রাচীর পার হয়ে একটি স্তম্ভ ঘেরা অলিন্দে এসে ঢুকলো। ভেতরে ছোটো একটি কুঠুরী। কুঠুরীর ভেতর বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। এই কুঠুরীর ভেতর বসেই কুয়াশা দিনের পর দিন কাজ করে চলেছে। আখতানের নক্সার পাঠোদ্ধার করে একটু একটু সে এগিয়ে চলেছে পিরামিডের সেই স্থানটিতে যেখানে সাত রাজার ধন হাজার হাজার বছর ধরে লুকনো আছে। গতকাল সে পিরামিডের সপ্তম প্রাচীর ভেদ করেছে। যদি নক্সার কথা সত্যি হয় তাহলে আর একটি প্রাচীর উত্তীর্ণ হলেই তার কাজ উদ্ধার হবে। আশা ও আশঙ্কায় বুক দুলছে। সে কুঠুরীতে ঢুকে দেখলো জেনারেটরের এক পাশে গোগী দাঁড়িয়ে আছে। স্থির চোখে সে বিদ্যুতের তীব্র আলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কুয়াশাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যে তার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। পরক্ষণেই তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো বিশ্বাস ও আনন্দের হাসি।