মি. হাসান ডয়ার থেকে সুদৃশ্য সিগারেট কেস বের করলেন। কেসে পর পর কুড়িটি ফিল্টার্ড রথম্যান সিগারেট সাজানো আছে। কেসটি খুলে মি. হাসান সেটি বিনয়ের সঙ্গে বাড়িয়ে দিলেন মিঃ সিম্পসনের দিকে। ধন্যবাদ দিয়ে সিম্পসন একটি গ্রহণ করলেন। পুলিস সুপারের এয়ার কণ্ডিশন্ড ঘরের বাতাস চক্রাকার নীল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। দুজনই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধূমপান করলেন। নীরবতা ভঙ্গ করলেন মি. হাসান। বললেন, আমার সরকারের পক্ষ থেকে সদাশয় বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসাবে আপনাকে আগেই স্বাগতম জানিয়েছি মি. সিম্পসন। তারপর শুধু এইটুকু বলতে পারি এই ব্যাপারে আমাদের তরফ থেকে যে কোনো সাহায্য, যে কোনো। প্রতিশ্রুতি দিতে বললে আমরা প্রস্তুত।
সিম্পসন ধন্যবাদ জানালেন।
মি. হাসান বললেন, জেবা ফারাহ সম্পর্কে ইতিমধ্যে যে ফাইলটি করা হয়েছে। সেটি আপনাকে দেবার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের মহামান্য সরকার। ফাইলটি এখুনি আপনাকে দেবার ব্যবস্থা করছি। আমার বিশ্বাস জেবা ফারাহ্ ও তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী খোদাবক্সের হত্যা সম্পর্কে আপনি অনেক নতুন সূত্র ও তথ্য এতে পাবেন।
সিম্পসন বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ দেবার ভাষা আমার নেই। আমার ও আমার সরকারের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন। এই দুই বন্ধু রাষ্ট্রের ভেতর প্রীতি ও সৌহার্দ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক এই কমনা করি।
ইতিমধ্যে কফি প্রস্তুত হয়েছে। মি. সিম্পসনকে নিয়ে মি. হাসান প্রশস্ত বরান্দার অঙ্গনে গিয়ে বসলেন। বাইরে তীব্র উজ্জ্বল রোদ। কায়রো নগরের সুউচ্চ অট্টালিকারাজি চারদিকে দণ্ডায়মান। একটা বাতাস লুর তপ্ত হল্কা ছড়াতে ছড়াতে ছুটে এলো। মি. সিম্পসন অভ্যাসবশতঃ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে নিলেন। হঠাৎ অদূরবর্তী রাজপথের একদিকে চোখ পড়াতে তাঁর দৃষ্টি থমকে গেল। চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। লোকটিকে ঢাকায় তিনি দেখেছেন। লোকটি কৃষ্ণকায়। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ দেহ। মাথার কুঞ্চিত চুল ফুলে ফেঁপে ঘাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে। চ্যাপ্টা নাকের নীচে পুরু ঠোঁট। দুটি হাত পেছনে নিয়ে লোকটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এদিকে? হঠাৎ সিম্পসন সাহেবের সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে লোকটা যেন কিছু হয়নি এভাবে চট করে এক পাশে ঘুরে গেল। ঘুরে গিয়ে চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তাকে দেখা গেল না।
মি. হাসান উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন, এনিথিং রঙ মি. সিম্পসন?
নাথিং সো সিরিয়াস।
মি. সিম্পসন একটু হাসেন। তাকান মি. হাসানের দিকে। বলেন, যদি অসুবিধে না হয় তাহলে আমি আজই মহামান্য রাজকুমারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
মি. হাসান বিনীতভাবে আশ্বাস দিলেন-মহামান্যা রাজকুমারীকে আগেই সংবাদ পাঠিয়েছিলাম। তিনি সানন্দে আপনার সঙ্গে আজ বিকেল চারটায় দেখা করতে রাজি হয়েছেন।
আপনার কাছে আমি চির বাধিত মি. হাসান।
মি. হাসান হেসে বললেন, আমাদের আতিথেয়তার ত্রুটি হয়তো থাকবে মি. সিম্পসন, কিন্তু অকপট বন্ধুত্বের হৃদয় আপনাকে উপহার দিতে পারবো।
.
মহামান্যা রাজকুমারী আয়িদা বানুর সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ করে মি. সিম্পসন পথে নামলেন। কায়রোর রাজপথ অতি সুদৃশ্য। সুউচ্চ অট্টালিকাসমূহের উপর মিনার শোভা পাচ্ছে। রাস্তার এখানে সেখানে উটের গলায় ঘন্টা ধ্বনি। রাস্তায় নেমে ভাড়া করা ট্যাক্সি নিলেন মি. সিম্পসন। হোটেলের নাম ঠিকানা বলতেই ট্যাক্সি চালকের চোখে মুখে সম্মান ও বিনয়ের ভাব ফুটে উঠলো।
সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ ধূমপান করছিলেন মি. সিম্পসন আর চিন্তাকীর্ণ মনে আগাগোড়া সবটা ব্যাপার তলিয়ে দেখছিলেন। মিশর দেশীয় সুলতানদের একটা নক্সা যে এমন একটা রক্তক্ষয়ী, রহস্যময় ঘটনার জন্ম দেবে তা কে জানতো? নক্সাটি, সম্ভবতঃ ছিলো মিশরের শেষ শক্তিশালী ফারাউন প্রথম আখৃতানুনের। আমন দেবতার পূজো বর্জন করে মিশর দেশে তিনি সূৰ্য্য দেবতার পূজো চালু করেছিলেন। ফলে তাকে আমন দলীয় শক্তিশালী পুরোহিতদের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছিল। আখতানুন তাতে ভয় পাননি। তিনি রাজধানী সরিয়ে নিলেন কায়রো থেকে। কথিত আছে রাজধানী সরিয়ে নেবার সময় রাজকোষের বিপুল অর্থরাজি তিনি তাঁর পিতামহের সমাধি মন্দিরে প্রোথিত করে যান। প্রয়োজনের সময় যাতে এই অর্থ তিনি উদ্ধার করতে পারেন তার ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। সমাধি মন্দিরের গুপ্তকক্ষের চিহ্ন ও পথ তিনি একটি নক্সায় টুকে রাখেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমন দলীয় পুরোহিতদের হাতে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। ঘটনাচক্রে এই নক্সা গিয়ে পড়ে দয়ালু রাজা আখতানুনের জ্ঞানী চিকিৎসকের হাতে। এই চিকিৎসকটি দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবৎ জানতেন যে তিনি এক সাধারণ মজুরের পুত্র। কিন্তু কালক্রমে বৃদ্ধ দশায় উপনীত হয়ে তিনি জানতে পারলেন তার দেহে আছে রাজ রক্ত। শুধু তাই নয় পূর্ববর্তী ফেরাউনের উইল অনুযায়ী আখতানেরও পূর্বে সিংহাসনের উপর ছিলো তাঁর অধিকার। জ্ঞানী চিকিৎসক ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হলেন। কিন্তু তিনি নির্বোধ ছিলেন না। সিংহাসনের অধিকা জানাতে গেলে তাঁকে যে বহু রক্ত ও লোক ক্ষয় করতে হবে তা তিনি জানতেন। তিনি নিঃশব্দে সিংহাসন ও রাজ দরবারের কুটিল পরিবেশ ত্যাগ করে গ্রামান্তরে চলে যান। তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ আত্মজীবনীতে এই নক্সার উল্লেখ করেছেন। চিকিৎসকের মৃত্যুর পর এই নক্সার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি দীর্ঘ তিন হাজার বছর। সেই চিকিৎসক এবং আখতানুনের নক্সাটির কথা ততদিন ইতিহাস পাতায় বিস্মৃত হয়েছে। ১৯৪২ সালে একদল ফরাসী ভূতত্ত্ববিদ দুশো ফিট মাটির নিচ থেকে আকস্মিকভাবে এই নক্সা এবং চিকিৎসকের আত্মজীবনীটি উদ্ধার করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই নক্সা এবং গ্রন্থটি এমনভাবে সংরক্ষিত ছিলো যাতে কালের এতটুকু অবক্ষয়ের চিহ্ন তাতে পড়েনি। এই নক্সার স্বত্ব নিয়ে ফরাসী সরকার ও মিশরের রাজ পরিবারের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। মিশরের রাজ পরিবার স্বাভাবিক ভাবেই এই নক্সার স্বত্ব দাবি করতে পারেন। কিন্তু গোলযোগ বাধিয়েছিল আত্মজীবনীতে লিখিত জ্ঞানী চিকিৎসকের কয়েকটি পংক্তি। তিনি এই নক্সা সম্পর্কে বলেছেন, আইনতঃ এই নক্সার মালিকানা আমার। ইচ্ছে করলে এই নক্সায় নির্দেশিত ধন সম্পত্তি উদ্ধার করে তা আমি ভোগ করতে পারতাম। কিন্তু তা আমি করনি। করিনি কারণ আমি জানি ঈশ্বরের ইচ্ছে তা নয়। এই সম্পত্তি ভোগ করার মালিকানা ফিরাউন বা রাজবংশীয় লোকদের কি তাদের অধীনস্থ সাধারণ মানুষের এই প্রশ্ন আমার মনে বারবার দেখা দিয়েছে। মহাকালের হাতে এর বিচারের ভার ছেড়ে দিলাম।