কিন্তু এবার সেই লোকটির বিস্মিত হবার পালা। যুবতীর দিকে তাকিয়ে তার বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ঢাকার অভিজাত হোটেল কক্ষে যার মৃতদেহ নিজের চোখে সে দেখেছে সেই জেবা ফারাহর জীবন্ত মূর্তি তার চোখের সামনে। না, কোনো ভুল নয়। এ সেই জেবা ফারাহ। সেই আপেল-রাঙানো মুখ। মায়াবী নীল চোখ। তীক্ষ্ণ চিবুকের উপর পুরুষ্টু রঙিন ঠোঁট। জেবা ফারাহ্। আশ্চর্য…যাকে নেসার আহমেদ নিজের হাতে খুন করেছিল সেই জেবা ফারাহ্ তারই বাহুবন্ধনে! তারই নিঃশ্বাসের একান্তে নিঃশ্বাস ফেলেছে!
মেয়েটি আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। আত্মহত্যার সমস্ত প্রবণতা, ও উত্তেজনা কাটিয়ে তার চোখ মুখ, শরীর এখন বিমর্ষ ক্লান্ত। লোকটি ইংরেজিতে বললো, তুমি জেবা ফারাহ্
জেবা ফারাহ্
মেয়েটি মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠলো। পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিলো, তুমি জেবা ফারাহকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। ঢাকার এক হোটেলে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তুমি কি তার বোন।
হ্যাঁ, আমরা দুবোন যমজ। আমার নাম দিবা ফারাহ্। মেয়েটি আস্তে আস্তে শ্বাস টানলো। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর কান্নার গলায় বললো, কিন্তু তুমি কে? কেন তুমি আমাকে বাঁচালে?
লোকটি একটু হাসলো। ততক্ষণে তার মন থেকে সমস্ত অলীক ভয় আর দুর্ভাবনা কেটে গেছে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে পড়েছিল দুজনের গায়ে। সেই আলোয় পরস্পরকে তারা দেখলো।
লোকটি বললো, তুমি মরতে চাইছে কেন?
বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই, তাই। তুমি বিদেশী। তুমি কায়রোর অভিজাত বংশের নষ্ট হয়ে যাওয়া মেয়ে জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহর দুঃখ বুঝবে না।
তা বটে।
লোকটি সহজ গলায় হাসলো। বললো, কিন্তু জানেনা, ইচ্ছে করলেই সহজ ও স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকা যায়। তুমি যদি আমাকে বিশ্বাস করো তাহলে আমাকে তোমার সব কথা খুলে বলো। আমি তোমাকে সাহায্য করবে।
মেয়েটি বিদ্রূপ ভরে হেসে উঠলো। বললো, তোমার সাহস আছে বটে। যুবতী নারীর বিপদে নির্ভয়ে এগিয়ে আসার মনও আছে। কিন্তু শোনো বিদেশী, আমাকে দুনিয়ার কেউ বাঁচাতে পারবে না। আমার মরার একটুও ইচ্ছে ছিলো না…
গলাটা ভেঙে এলো তার, বিশ্বাস করো আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু চাইলে কি হবে? মৃত্যু আমার অনিবার্য। মরতে আমাকে হবেই।
লোকটি তার কথায় প্রতিবাদ করলো না। শুধু বললো, তুমি তো এমনিই মরতে যাচ্ছিলে। আমি বাধা না দিলে এতক্ষণে তুমি মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে থাকতে।
হ্যাঁ, থাকতাম। কিন্তু তুমি কে? কেন তুমি… :
একটু হেসে সে আবার বললো, বর্তমানে আমার একটা নামই প্রচলিত। আর সব নাম, পরিচয় ঢাকা পড়েছে। আমার নাম কুয়াশা। তোমাকে বাঁচান যায় কিনা একবার আমাকে চেষ্টা করতে দাও।
কুয়াশা? দীবা ফারাহ স্তব্ধ হয়ে রইলো অনেকক্ষণ। সে তাকিয়ে রইলো কুয়াশার বলিষ্ঠ দেহ আর সুন্দর সুঠাম মুখের দিকে। কুয়াশার নাম সে জানে। জেবা ফারাহ, তার বোন, কুয়াশাকে নম্বর ওয়ান শক্ত বলে গণ্য করতো। জেবা দুনিয়ার কাউকে ভয় করতো না। কিন্তু কুয়াশার নামে সে কম্পিত হতো। বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর লোকটি, সেই কুখ্যাত কুয়াশা তারই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে, দীবা যেন কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
কুয়াশা হাসলো। বললো, দীবা, যে মরতে চায় তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না। কিন্তু যে বাঁচতে চায় তার জন্য জীবনের কোনো না কোনো পথ খোলা থাকেই। ভোর হয়ে গেছে। আর দেরি করতে পারি না। চলো।
কোথায়?
কাছেই আমার লঞ্চ। সেখানে চলো।
দীবা একবার তাকালো কুয়াশার দিকে। অবিশ্বাসের কিছু ছিলো না। কুয়াশার চোখের স্পষ্ট সরল চাহনী, তার হাসি দিবার মন থেকে সব দুর্ভাবনা দূর করে দিলো। তার মন বললো এই লোকটার যতো কুখ্যাতি থাক, নিষ্ঠুরতার যতো দুর্নামই থাক, এ কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। নির্ভয়ে একে আশ্রয় করা যায়।
সে বললো, একটা কথা।
বলো।
আমাকে তুমি আশ্রয় দিচ্ছো। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছো। তোমাকে এজন্যে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। হয় তো…
সশব্দে হেসে উঠলো কুয়াশা। পথ দেখিয়ে বললো, চলো। আর দেরি নয়।
তখন ভোর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোয় মরুভূমি উদ্ভাসিত। খেজুর গাছের সারি দুই পাশে রেখে নীল-নদ বয়ে চলেছে কুলকুল বেগে। দিনটা ভারি সুন্দর।
.
০৪.
কায়রোর পুলিস সুপার মি. গামাল হাসানের মুখোমুখি বসেছিলেন মি. সিম্পসন। খোদাবক্স হত্যা ঘটনার তদন্তে জড়িত হয়ে তিনি সুদূর মিশরে এসেছেন। স্কটল্যাও ইয়ার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত এই গোয়েন্দাটির কার্যকলাপ সর্বত্র উচ্চ প্রশংসিত ছিলো। মি. গামাল হাসানও এর সম্পর্কে যথেষ্ট শ্রদ্ধার ভাব পোষণ করেন। কিন্তু খোদাবক্স হত্যা ঘটনার বিবৃতি দিতে গিয়ে মি. সিম্পসনের চোখে ব্যর্থতা ও ক্লান্তির যে ছায়া ফুটে উঠলো তা দেখে গামাল হাসান একটু অবাক না হয়ে পারলেন না। মি. সিম্পসন বলেছিলেন, আমি জীবনে অনেক রহস্যময় ঘটনা ও চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত হয়েছি মিঃ হাসান এবং শক্তি আমার যতটুকু থাক, আমি কখনো আত্মবিশ্বাস হারাইনি। কিন্তু এই ব্যাপারটা…
মি. সিম্পসন একটু হাসলেন। তাকালেন মিঃ গামাল হাসানের দিকে। বললেন, বুদ্ধি, সাহস, আত্মবিশ্বাস সব যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে।