খুট করে একটা শব্দ উঠলো নিকটবতী পিরামিডের পাদদেশে। ভারি পাথরের দরজা ঠেলে কেউ যেন বেরিয়ে এলো মৃত্যু শীতল গহ্বর থেকে। একটা দীর্ঘকায় মানুষের ছায়া। আপাদমস্তক ভারি কাপড়ে আবৃত। হাতের আঙুলে সিগারেট জ্বলছে। চোখে মুখে পরিশ্রমজনিত স্বেদ-বিন্দু। বাইরে এসে লোকটি বুক ভরে মুক্ত বাতাস গ্রহণ করলো। ডারি ওভারকোটটা খুলে ভাঁজ করে হাতে রাখলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝলো রাত ভোর হতে বেশি বাকি নেই। দূরের পুব-আকাশ একটু একটু করে স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। উপরের আকাশ থেকে একটা একটা তারা নিভে যাচ্ছে। হাওয়ার বেগ বাড়ছে আস্তে আস্তে। একটু পরেই মরুভূমির বেদুইনের কণ্ঠে শোনা যাবে আজান।
লোকটি পিছন ফিরে তাকালো। গোগী আসছে না কেন? সে হাতের তালুতে বার তিনেক সাঙ্কেতিক শব্দ বাজালো। দেখতে দেখতে গুহার মুখ হতে উপরে উঠলো একটা বিপুলকায় ছায়া। লোকটা ফিসফিস করে কি যেন বললো। মুহূর্তেই গোগী হেলেদুলে কাছে কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের সিগারেট ততক্ষণে নিঃশেষিত। সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে লোকটা ধীর পদক্ষেপে সামনে এগোলে।
মরুভূমির পথ। এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে অজস্র খেজুর গাছ। খেজুর গাছের সারি ঘণ হয়েছে নদীর বাঁকের কাছে। চারপাশে চোখ তুলে তাকালে বালির পাহাড়, পিরামিড আর শীর্ণকায় খেজুর গাছ ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না সেখানে। বিধাতার আশির্বাদের মতো কুলুকুলু বেগে বয়ে চলেছে নীল নদ।
নদীর তীরে এসে দাঁড়ালো লোকটা। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো। চারপাশে আবছা অন্ধকার। ফিকে কুয়াশা। হাওয়ার শব্দ। লোকটি সিগারেট টানছে। দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ দেহ। তীক্ষ্ণ, খাড়া নাক। চোখ- জোড়া উজ্জ্বল তারার বিন্দুতে জ্বলছে। অপূর্ব সুন্দর একটি পুরুষ… দেখে মনে হয় যেন গ্রীক-স্থপতির তৈরি একটা জীবন্ত অস্কর মূর্তি। বড় ক্লান্ত সে। লোকটি চুপচাপ বালির ওপর বসলো। গত তেরো রাত ধরে তার ঘুম নেই। সকাল বেলা আবশ্যকীয় কাজ-কর্ম সেরে নির্দিষ্ট গুহায় ঢোকে। সারাদিন সারারাত কাজ করে। যখন কিছুতেই পারা যায় না তখন সে গুহার পাথরেই মাথা রেখে চোখ বোজে। জিরিয়ে নেয়। এভাবে কতদিন যাবে কে জানে? ধরতে গেলে আসল কাজের কিছুই হয়নি। এখনো যেন গুহার গোলক ধাঁধায় ঘুরে মরছে। মনে হচ্ছে মৃত্যুর হাতছানি যেন তাকে ক্রমেই জটিলতার গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যুর হাতছানিই হোক আর মৃত্যুই হোক, যে কাজে একবার সে হাত দিয়েছে কাজ শেষ না করে তো সে কিছুতেই সরে যেতে পারে না। এ তার স্বভাব বিরুদ্ধ। এক টুকরো হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। অতীতের দিকে চাইলো সে ফিরে। মনে পড়লো আফ্রিকার সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা। শহীদ, কামালের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। কই, বিপদ, মৃত্যু ভয় কিছুই তো তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। এবারেই কি সে ব্যর্থ হবে? না অসম্ভব। মউত কবুল কিন্তু পরাজয় নয়।
সে উঠে দাঁড়াতে গেল। ঠিক এই সময় মোটরের হেড লাইটের তীব্র আলোর ঝলকানি এসে লাগলো তার গায়ে। মুহূর্তে সে আত্মগোপন করলো একটা ঢিবির পাশে।
গাড়িটা নদীর ঠিক বাঁকটার পাশে গিয়ে থামলো! এঞ্জিনের শব্দটা স্তব্ধ হলো। কৌতূহলী চোখ মেলে লোকটা দেখলো সেই গাড়ির আরোহী এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা। ধীর পায়ে সে গাড়ি থেকে নামলো। নিকটবর্তী হলো নদীর। কি ভেবে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে উপরে চোখ তুলে আকাশ দেখতে লাগলো। বাতাসে তার ওড়না উড়ছে, মাথায় এলোমেলো কুন্তল উড়ছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
আশ্চর্য তো! টিবির ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো লোকটি! এই শেষ রাতের ভয়াবহ নির্জনতায় এই পুরবাসী মহিলা এখানে কেন? দয়িতের সন্ধানে? হবে হয়তো। কারো কারো মনে প্রেম এনে দেয় অস্থিরতা। এনে দেয় ঘর ছাড়ার বার্তা। হয়তো প্রেমের অস্থিরতাই এই যুবতী মহিলাকে ভোর রাতের বিভীষিকাময় নীল নদের তীরে ডেকে এনেছে। কিংবা কে জানে কি রহস্য জড়িয়ে আছে এই যুবতীটির জীবনে। লোকটি সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। কৌতূহল তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে দেখলো মহিলার দুই চোখ উদভ্রান্ত। শেষ রাতের ফিকে আলোয় অদ্ভুত রহস্যময়ী বলে মনে হচ্ছে যুবতাঁকে। বুকের ওড়না উড়ে গিয়ে আটকে গেছে দুই বাহুতে। শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট। শরীর বেয়ে যৌবন যেন উপচে পড়ছে।
মানুষ আলোর রহস্য দেখে যে চোখ দিয়ে, মুক্তির রূপ দেখে যে চোখ দিয়ে, সেই চোখ মেলে তাকিয়ে রইলো লোকটি। কিন্তু ওকি। সহসা সেই নারী দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠলো। বাহুর বাঁধন ছেড়ে বাতাসে উড়ে গেল ওড়না। সাপের ফণার মতো উথলে উঠলো চুলের স্তবক। কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই যুবতীর। দুই হাতে মুখ ঢেকে সে ফোঁপাতে লাগলো। বেদনা সজল শুকতারাটি তখন মাথার ওপর জ্বল জ্বল করছে। বহু দূরবর্তী ডোঙার মাঝি ভোরের আজান দিচ্ছে উচ্চকণ্ঠে।
যুবতীটি কান পেতে সেই ভোরের আজান শুনলো। কি ভেবে যেন শিউরে উঠলো। মাথা ঝাঁকালো বার কয়েক। তারপর উন্মত্তের মতো ছুটে গেল নদীর দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটি বুঝলো, আর কিছু নয় যুবতী আত্মহত্যা করতে চলেছে। একটুও দেরি না করে সে ছুটে এগিয়ে গেল। নদীর বিশাল বুক তার জন্যে অপেক্ষা করছে। সেখানে অতল শান্তি। অসীম মুক্তি। যুবতীটি ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। কিন্তু পারলো না। কিসে যেন আটকা পড়েছে। সে আর কিছু ভাবতে পারছিল না। ক্রমাগত কেপাচ্ছিল। কাঁদছিল। দূরের দিগন্ত রেখায় রক্তিম বর্ণে আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঠছিল, লোকটির বাহুতে হেলান দিয়ে রোরুদ্যমানা যুবতী সেই দিকে তাকিয়ে রইলো। এক, মুহূর্তের এদিক ওদিক হলে সে তলিয়ে যেতো নদীর অতল জলে। ভাগ্যের চক্রান্তে অপরিচিত এই লোকটি তাকে রক্ষা করেছে। কিন্তু একে কি রক্ষা বলে? এ যে যন্ত্রণার অধিক যন্ত্রণা। আবার তাকে সেই কুট চক্রের শিকার হতে হবে ভেবে যুবতী কাঁদতে লাগলো।