ও কে…
সিম্পসন সাহেবের নির্লিপ্ত গলার স্বর শোনা গেল।
ইন্সপেক্টরের পোশাক পরা লোকটি সামনে এগিয়ে এলো। বিনীত কণ্ঠে বললো, সিম্পসন সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন স্যার। আমার নাম আলী আহমেদ।
কামাল বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে বললো, আপনারা কি পায়ে হেঁটে এখানে, এসেছেন, ইন্সপেক্টর সাহেব?
আই. বি. ইন্সপেক্টর মৃদু হাসলো। বললো, আর বলবেন না স্যার। অর্ডার পেয়েই, যখন তখন আমরা রওনা হয়েছিলাম। কিন্তু রেল গেটে এসে পাক্কা পনেরো মিনিট দেরি করতে হয়েছে।
আপনি মৃতদেহ গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা করুন। শহীদ গম্ভীর হয়ে বললো, ঘটনাটা আমি খুলে বলছি।
এক মুহূর্ত ভাবতে হলো শহীদকে। কামালের বাড়িতে সে এসেছিল সন্ধ্যা কাটাবার জন্যে। কিন্তু সময়ের রঙ্গমঞ্চে কখন যে কি ঘটে বলা মুস্কিল।
সে ঘটনাটি খুলে বললো। বিস্ময়ে, উত্তেজনায় ইন্সপেক্টর আলী জ্বল জ্বল চোখে তাকিয়ে রইলো। শহীদ বলা শেষ করলে সে রুদ্ধশ্বাসে বললো, বীভৎস কাণ্ড, স্যার।
সে মৃতদেহটি উল্টে পাল্টে পরীক্ষা করলো। ডায়রীতে কয়টা কথা তুলে নিলো। এক সময় শহীদকে বললো, স্যার, যদি অপরাধ না নেন তো একটা কথা জিজ্ঞেস করি–
স্বচ্ছন্দে…
এই হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে আপনার কি ধারণা স্যার?
শহীদ এক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গোয়েন্দা ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালো। তারপর বললো, এ সম্পর্কে আমার যা ধারণা তা যথাসময় সিম্পসন সাহেবকে আমি জানিয়ে দেববা ইন্সপেক্টর। আমি এখন মনের দিক দিয়ে স্থির নই। আশা করি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিলাম না বলে কিছু মনে করেন নি আপনি
না, না…স্যার…
পুলিস ইন্সপেক্টর বিনীতভাবে হাসে। একটা সূক্ষ্ম বিদ্রুপের রেখা তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেই পরক্ষণে মিলিয়ে যায়। বললো, আপনি কিনা গোয়েন্দা বিভাগের আদর্শ পুরুষ..আপনার তো স্যার চোখের নজরই আলাদা। তাই বলছিলাম আর কি
কামালের মনে হলো ইন্সপেক্টর যেন শহীদকে ঠাট্টা করলো। একটু অবাক না হয়ে সে পারলো না। ততক্ষণে মৃতদেহ গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। পুলিস দুজন আবার ফিরে এলো ঘরে।
স্যার…
ইন্সপেক্টর আলী বিনীত হেসে বললো, স্যার, সিম্পসন সাহেব বলেছিলেন খোদাবক্সের কোমরে একটা রূপোর তাবিজ আছে। তাবিজটা দেখছি না।
শহীদ চোখ তুলে তাকালো। সূক্ষ্ম হাসির একটা ক্ষীণ রেখা ওর ওষ্ঠ প্রান্তে উঠেই মিলিয়ে গেল। হাসিটা কেমন যেন বেদনা রাঙানো আর নিষ্পহ। শহীদ দেখলো দুদরজার গোড়ায় দুজন গোয়েন্দা পুলিস রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে গেছে। ইন্সপেক্টর আলীর ডান হাতটা রিভলবারের একান্ত কাছে। ইন্সপেক্টর আলীর দিকে চেয়ে দেখে লোকটাকে শহীদ নির্ভুল ভাবে চিনলো। লোকটা খুনী। স্তিমিত, আধ ভেজা দৃষ্টিতে জান্তব নিষ্ঠুরতা স্থির হয়ে জ্বলছে।
ইন্সপেক্টর আলী আগের মতোই হাসতে হাসতে বললো, তাবিজটা কোথায়, স্যার?
শহীদ মৃদু হেসে বলে, ডুয়ারে।
ইন্সপেক্টর আলী স্থির নেত্রে চারদিকে তাকায়। শহীদ বলে, সিম্পসন সাহেবকে আমার শুভেচ্ছা দেবেন।
নিশ্চয়ই।
নম্র গলায় বলার চেষ্টা করে ইন্সপেক্টর। এগিয়ে দুয়ার খোলে। হঠাৎ সাত রাজার ধন পেয়ে গেলে যেমন আনন্দে ফেটে পড়ে মানুষ, তাবিজটা পেয়ে ঠিক তেমনি উল্লাসে চঞ্চল হয়ে পড়ে ইন্সপেক্টর আলী। এক মুহূর্ত তাবিজটা খাঁটি কিনা তা তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলো, তারপর দ্রুত হাতে সেটা রেখে দিলো পকেটে।
কাজে সহযোগিতা করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, স্যার। সারা গোয়েন্দা বিভাগ আপনার কাছে আর একবার ঋণী হয়ে রইলো।
ইন্সপেক্টর আলী দ্রুত কথা সারে। দুজন সঙ্গী গোয়েন্দা পুলিস চকিতে ঘর পেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। কামালের দৃষ্টি এতক্ষণে ভরে যায় বিস্ময়ে। সে দেখলো শহীদ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইন্সপেক্টর আলী তার সঙ্গীদের মতোই প্রায় লাফিয়ে ঘর থেকে নামলো। তড়িৎ পায়ে গাড়িতে উঠলো। মুহূর্তে গর্জে উঠলো এঞ্জিন। একরাশ কাঁচা পেট্রোলের গন্ধ জায়গাটা ভরিয়ে দিয়ে গাড়িটা তীব্র বেগে ছুটে বেরিয়ে গেল।
শহীদ। কামাল বন্ধুকে ডাকলো। তার চোখে-মুখে দুর্ভাবনার চিহ্ন।
কি রে? শহীদ সাড়া দেয়।
আমার সন্দেহ হচ্ছে। মনে হচ্ছে। এরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক নয়। এরা খোদাবক্সের হত্যাকারী নেসার আহমেদের লোক!
সে আমি জানি…
শহীদ ম্লান হাসলো। বললো, সিম্পসন সাহেবের ফোন ছেড়ে দিয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই ওদের চিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু তখন কিছু করার উপায় ছিলো না।
কামাল উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠলো। শহীদ একটু হাসলো। আস্তে আস্তে বললো, যে জীবন থেকে বিদায় নিয়েছি সেই জীবনে ফিরে যাবার আর একটুকু ইচ্ছে নেই, তুই তো জানিস কামাল। এতক্ষণে যা ঘটলো তার ভেতর আমার নিজের কোনো ভূমিকা ছিলো না। আমি, তুই দুজনেই নির্বাক দর্শক। শুধু দুঃখ লাগছে হতভাগ্য খোদাবক্সের জন্যে। যাহোক, চল ওঘরে। না, দাঁড়া
শহীদ ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, শেষ কর্তব্যটা সেরে নিই।
সে টেলিফোনের কাছে যায়। সিম্পসন সাহেবকে সব কথা খুলে বলে।
সিম্পসন সাহেব সব শুনে আঁতকে ওঠেন, হাউ স্ট্রেঞ্জ।
শহীদ কেবল হাসলো।
.
০৩.
তখন রাত ভোর হয়নি। উন্মুক্ত নীল আকাশে ফুলকির মতো অজস্র তারা জ্বলছে। আবছা কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। বিস্তীর্ণ মরুভূমির এখানে ওখানে প্রেতাত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে পিরামিডগুলো। কোথাও অনুচ্চ পাহাড় বা টিলার ভূপ। উত্তর সীমানা থেকে জোরে হাওয়া বইলো। সেই হওয়ায় ধোঁয়া ধোয়া হয়ে উড়ে গেল সামনের কুয়াশা। হাওয়ায় কেপে উঠলো অদূরবর্তী খেজুর গাছের পাতা। চারদিক নির্জন নিস্তব্ধ।