.
আপন মনে গজর গজর করতে করতে স্টার্ট দেয়া অবস্থায় দাঁড়ানো উইলিজ জীপের কাছে এসে দাঁড়ালো ইন্সপেক্টর আলম। উঃ, মাতবুরি মারার জায়গা আর পায় না! শালা অ্যাংলো কুত্তার বাচ্চা! যাও, কোনও কথা শুনতে চাই না-এক্ষুণি রওনা হও! উ…উ…ই। তুই আমাকে হুকুম করবার কেরে শালা তোর কেনা গোলাম আমি? তোকে কে পরোয়া করে দাঁড়াও এমন ফাশান ফাশাবো যে বাপের নাম ভুলে যাবে। নিষ্ফল আক্রোশে ফেঁশ ফোঁশ করতে করতে বিপুল বপু মনিরুল আলম জীপের ফুট বোর্ডে এক পা রাখলো। সাথে সাথেই গাড়িটা বাঁ দিকে খানিকটা হেলে পড়লো।
নাও, চালাও, ড্রাইভার হুঙ্কার ছাড়ে মনিরুল আলম।
ড্রাইভার কথা না বলে হুকুম তামিল করলো। কাঁচা পেট্রোলের গন্ধ ছড়িয়ে গাড়ি ছুটে চললো। স্টিয়ারিং হুইল ধরে নিঃশব্দে বসে রইলো ড্রাইভার এজিদ শেখ। তার পাকানো গোঁফের প্রান্তদেশে সূক্ষ্ম একটু হাসি উঠেই মিলিয়ে গেল।
লাথি মারো অমন চাকরির মুখে…
মনিরুল আলম গজর গজর করতে লাগলো, সময় নেই, অসময় নেই “ইয়ে আর কি গাড়ি তখন জনাকীর্ণ জিন্না এ্যাভিনিউ ধরে ছুটে চলেছে। চারপাশে ব্যস্ত লোকের চলাচল। গাড়ি ঘোড়ার ভিড়। ভিড় বাঁচিয়ে নিপুণ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে এজিদ শেখ। মোড়ে এসে বললো, কোনদিকে যাবো, স্যার…
সোজা ধানমণ্ডি।
রাইট, স্যার।
এজিদ শেখ পাকা লোক। সে নরম গলায় উত্তর দিলো।
গাড়ি স্টেডিয়াম ছাড়ালো। মনিরুল আলম লক্ষ্য করলো না যে রেলওয়ে ক্রসিং এর কাছ থেকে একটি লাল রঙের ফোক্সওয়াগন ওদের পিছু পিছু সতর্ক ভাবে এগিয়ে আসছে। একটু লক্ষ্য করলে বুঝতে পারতো গাড়িতে বসা লোক তিনটির তীক্ষ্ম চোখের দৃষ্টি সোজা তাদের গাড়িটার দিকে থকে আছে। এসব কিছু লক্ষ্য করার উপায়ও অবশ্য তেমন ছিলো না। একে তো বিপুলকায় তুড়ি, ও ভারি রকমের রাত্রিকালীন ভোজনের আলস্যে মনিরুল আলম নির্জীব, তার উপর তার মেজাজ বড় সাহেব সিম্পসনের উপর দারুণ খাপ্পী। গাড়িতে বসে সে বরং চোখ বুজে ঢুলুনির আরাম খাওয়াটাই লাভজনক। মনে করলো। নতুন চাকরিতে বহাল হওয়া এজিদ শেখের পাকানো গোঁফের প্রান্তে সূক্ষ্ম হাসির অর্থ সে একবারও সন্দেহ করলো না। গাড়ি নিউ মার্কেট পার হয়ে কিছুদূর। গিয়েই জনবিরল গ্রীন রোডে প্রবেশ করলো পেট্রোল পাম্পের পাশ দিয়ে। ইন্সপেক্টর মনিরুল আলম চোখ বুজে ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ একবার সজোরে হ্যাঁচ্চো দিলো। গাড়ির দরজা জানালা কেঁপে উঠলো। একবার হাসলো এজিদ শেখ। তারপর গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে সোজা ঢুকে গেল লাল ইটের দেয়াল ঘেরা একটি বাড়ির প্রশস্ত অঙ্গনে। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ একটি লোক। এজিদ শেখ ততক্ষণে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দরজা খুলেছে।
কি হলো, এসে গেছি নাকি? মনিরুল আলম বিরক্ত হয়ে চোখ খোলে। আড়মোড়া ভেঙে গোটা দুই হাই তোলে। তারপর কোমরে হাত দিয়ে রিভলবারটা মনের অজান্তেই আছে কিনা একবার পরীক্ষা করে। দেখে যথাস্থানে জিনিসটা নেই। ঘুমের ঘোরটা দ্রুত কেটে আসতে থাকে তার।
ওটা পরীক্ষা করতে হবে না..দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ লোকটি প্রচণ্ড থাবায় মনিরুল আলমের কবজি চেপে ধরে। বলে, যদি গোলমাল করো, তাহলে ঐ দেখো পেছনে পিস্তল নিয়ে তোমার আজরাইল দাঁড়িয়ে আছে, একদম খুন হয়ে যাবে।
প্রবলভাবে চমকে ওঠে মনিরুল আলম। চোখ দুটি ভয়ে ও বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সে নিঃশব্দে আদেশ পালন করলো অর্থাৎ বসে রইলো। তার চোখের সামনে এজিদ শেখকেও বাঁধা হলো। হাত পা বেঁধে মনিরুল আলমকে নিয়ে যাওয়া হলো একটা পাঁচ বাই তিন হাত কুঠরীতে। ঘরে ভ্যাপসা গরম। চারদিকে বড় বড় মশা ভন্ ভন্ করছে। প্রথম নে নিঃসাড় হয়ে হাত বাঁধা অবস্থার কথা একবার ভাবলো। চুলকান যাচ্ছে না। একবার একটু ফুঁপিয়ে উঠেই ত্যা করে কেঁদে ফেললো সে।
বলিষ্ঠ লোকটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সে হুকুমের সুরে বললো, এই তাজা গর্দভটা এখানে থাক। বেশি গোলমাল করে তো ওষুধ দিয়ে গেলাম, টাইট করে রাখিস। নে, চল, একজনকে সে হুকুম করলো।
শহীদ ঘরের এক কোণ থেকে আর এক কোণ অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। ক্রমাগত ঘড়ি দেখছিল। সিম্পসন সাহেবকে অন্ততঃ পৌনে এক ঘন্টা আগে সে টেলিফোন করেছে। এখনও কোনও সাড়া নেই। সে অস্থির ভাবে টেলিফোনের কাছে গোল।
কামাল একটু দূরে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল। তারও মুখ গম্ভীর। ঘরের মাঝখানে পড়ে রয়েছে হতভাগ্য খোদাবস্ত্রের লাশ। সেদিকে তাকিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা সে মনে মনে তলিয়ে দেখছিল। শহীদকে টেলিফোনের কাছে যেতে দেখে সে বললো, এই নিয়ে বোধহয় তিনবার হলো না?
শহীদ কোনো জবাব দিলো না। নম্বর ঘোরাতে লাগলো। কামাল বিড়বিড় করে কি বললো।
এই সময় বারান্দায় বুটের শব্দ হলো। তিনজন ইউনিফর্ম পরা গোয়েন্দা পুলিসের লোক ঘরের পর্দা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলো। ঢুকেই আদাব দিলো।
সিম্পসন সাহেব তখন টেলিফোন ধরেছেন। শহীদ ততক্ষণে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছে। সিম্পসন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, হাউ স্ট্রেঞ্জ! আমি তো অনেকক্ষণ আগে ওদের পাঠিয়েছি। ওরা এখনো পৌঁছোয়নি
শহীদ বললো, এইমাত্র ঘরে ঢুকলো। অনেক ধন্যবাদ,সিম্পসন সাহেব। আমি মৃতদেহ এদের হাতে তুলে দিচ্ছি।