কুয়াশা! আশ্চর্য লোকটি! দীবা উন্মুখ হয়ে আছে তার একটি ডাকের জন্য, একটু আদরের জন্য, প্রীতিময় স্পর্শের জন্য। কুয়াশা নির্লিপ্ত। কোনো সাধারণ দুর্বলতা তার নেই। সে অপেক্ষা করছে বিপদমুক্ত দিনের জন্য।
পিরামিডের অন্ধকার কবরে দাঁড়িয়ে দীবা ভাবলো বিপদমুক্ত দিন কি সত্যি তার জীবনে আসবে?
পদশব্দে সে চমকে ফিরে তাকালো। কুয়াশা। দীবা হেসে উঠলো। দৌড়ে কাছে গেল। কুয়াশার একটা হাত তুলে নিলো নিজের হাতে। আঙুল উঁচিয়ে চুপ করবার ইঙ্গিত করলো দীবাকে কুয়াশা। কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো, চুপ, কথা বলো না। আমার সব কাজ শেষ। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। চলো…
কিন্তু গোগী?
কুয়াশা চারদিকে তাকালো। গোগী নেই। বললো, ভয়ানক জখম হয়েছে বেচারা-বোধহয় কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে। চল, এগোই। সতর্ক হয়ে ওরা রাজা আকতানুনের শয়ন মন্দির থেকে বাইরে এলো। দুপাশে সঙ্কীর্ণ খড়ি দেয়াল। দেয়ালের কোণে কোণে খাপ পেতে আছে শত্রু। ম্যান-ট্র্যাপের ভয়। কুয়াশা সাবধানে টর্চটা ব্যবহার করলো। সপ্তম প্রাচীর পর্যন্ত বিনা বাধায়ই এলো। যষ্ঠ প্রাচীরে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। চকিতে দীবাকে ঠেলে নিয়ে এক পাশে সরে গেল। একটা অট্টহাসি শোনা গেল কাছেই। দেখতে পেয়েছে ওদেরকে নেসার। কুয়াশা অস্থির হয়ে উঠলো। প্রতিহিংসার আগুনে তার চোখ জ্বলছিল। সে নিঃশব্দে দীবাকে কাছে। টানলো। ম মুহূর্ত যদি আর না আসে। পর মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লো অন্ধকারে।
অন্ধকারে দুটি দুধর্ষ শক্তিশালী মানুষের হিংস্র যুদ্ধ তুমুল হয়ে উঠলো। প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ নয়, নেসার আহমেদ। সে অট্টহাস্য করছিল। বলছিল, আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল যে এসব ভৌতিক কাজ আর কারো নয়, কুয়াশার। আজ তোকে হাতে পেয়েছি কুয়াশা। তোর বুকের রক্ত শুষে খাবো আমি। আমার হাতে তোর নিস্তার নেই আজ।
প্রত্যুত্তরে কুয়াশার হিংস্র গর্জন শোনা গেল।
দীবা স্থির, অচল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ পর একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ভেসে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এলো কুয়াশা। তার সারা শরীর রক্তে প্লবিত। বললো, নেসার পালিয়েছে দীবা। তুমি এই পথে সোজা লঞ্চে চলে যাও, আমি আসছি।
হঠাৎ সারা পিরামিড যাদু-মন্ত্রের মতো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। আর সেই আলোয় পালিয়ে বেড়াতে থাকলো গুপ্তধন লোভী নিশাচরের দল। চারদিকে গুলি গোলার আওয়াজ আর ধোঁয়ার ঝাপ্টা।
পাগলের মতো কুয়াশা খুঁজছে নেসারকে। মাথায় খুন চেপে গেছে তার। অলিন্দ দিয়ে ছুটলো সে নেসারের পিছু পিছু। হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই কুয়াশা দেখতে পেলো নেসারের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে গোগী। সে-ও বুঝি খুঁজে ফিরছিল নেসারকে।
এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে আসছিল নেসার আহমেদ। আর খোঁড়াতে খোঁড়াতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসছিল সেই ভয়ঙ্কর গরিলা হিংস্র গর্জন করতে করতে। সারা অঙ্গে তার ব্যাণ্ডে জ জড়ানো মমির ছদ্মবেশ। বাঁ পায়ের উরুর কাছে ব্যাণ্ডেজ লাল হয়ে ভিজে গেছে রক্তে। বীভৎস দেখাচ্ছিল ওকে।
হঠাৎ শোল্ডার হোলস্টার থেকে টান দিয়ে পিস্তলটা বের করলো নেসার। উদ্যত ছুরি হাতে পিছন থেকে ছুটে এলো কুয়াশা। কিন্তু ততক্ষণে দুটো গুলি বেরিয়ে গেছে পিস্তল থেকে। পিস্তল দেখেই লাফিয়ে উঠেছিল গোগী। প্রথম গুলিটা লাগলো না তার গায়ে-কিন্তু দ্বিতীয়টা লাগলো গিয়ে ডান পায়ের ঠিক হাঁটুর নিচে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল গোগী মাটিতে।
সাথে সাথেই হুমড়ি খেয়ে তার পাশে পড়লো নেসার আহমেদ। পিঠের উপর তার আমুল বিঁধে আছে কুয়াশার হাতের ছুরিটা। প্রাণটা তখনও বেরোয়নি। আহ! এক অপার্থিব চিৎকার বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে।
হাতের কাছে পেয়ে ক্রোধমত্ত গোগী নেসারের হাঁ করা মুখের দুই পাটি দাঁত দুই হাতে ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। গলগল করে বেরিয়ে এলো তাজা রক্ত। নেসারের সেই চেহারার দিকে আর তাকাতে পারলো না কুয়াশা-শিউরে উঠে দৃষ্টি ফেরালো সে অন্যদিকে।
কাম গোগী। কুয়াশা ডেকেই পিছন ফিরলো। এখন পালাতে হবে এখান থেকে। একদল লোক দ্রুত এগিয়ে আসছে। তাদের কথাবার্তার শব্দ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে। কুয়াশা চিনলো সিম্পসনের গলা। নিশ্চয়ই সশস্ত্র বাহিনী আছে সঙ্গে। আর দেরি নয়।
আরে, একী! গোগী আবার পড়ে গেল কেন? কুয়াশার আদেশ পাওয়া মাত্রই অভ্যাস বসে একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছিল গোগী। কিন্তু দুই পা এগিয়েই হাঁটু ভাঁজ হয়ে সামনের দিকে পড়ে গেল সে। আর চলতে পারছে না।
বিস্মিত কুয়াশা দেখলো দুই পায়েই মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে গোগী। সম্পূর্ণ ভাবে চলৎশক্তি হারিয়েছে সে। কিন্তু সময় নেই–আর তো অপেক্ষা করা চলে না। আর পনেরো সেকেণ্ড অপেক্ষা করলেই ধরা পড়ে যাবে সিম্পসনের হাতে। পালাতে হবে এখান থেকে এই মুহূর্তে। উপায় নেই, গোগীকে পিছনে ফেলেই যেতে হবে।
মনটাকে শক্ত করে ঘুরে দাঁড়ালো কুয়াশা। তারপর এগিয়ে গেল তার একমাত্র বিশ্বস্ত এবং প্রিয় সাথীকে পিছনে ফেলে। জীবনে একটিবারও যে ধোঁকা দেয়নি কখনও এমন বন্ধুকে এই অসহায় অবস্থায় ফেলে পালাতে হৃদয়টা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিলো কুয়াশার। কয়েক পা এগিয়ে থামলো কুয়াশা। আবার পিছন ফিরে চাইলো। দেখলো গোগীর চোখে করুণ মিনতি–আমাকে বাঁচাও প্রভু, আমাকে ফেলে চলে যেয়ো না।