দলের নেতা হাসলো। বললো, আজ আমার হাতে কারো নিস্তার নেই। আজ আমি পরাজয় আর অপমানের প্রতিশোধ নেবোই।
মি. শরীফ বললো, আপনি স্যার কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা সকলেই যে কোনো এনকাউন্টারের জন্য প্রস্তুত। বাইরে আমাদের জন্য একটা পুরো ব্যাটেলিয়ান রিজার্ভ রয়েছে।
ফিস ফিস করে দলের নেতা বললো, আমি সবচেয়ে কাকে ভয় করি জানেন মিঃ শরীফ?
কাকে স্যার?
দলের নেতা একটু হাসলো। বললো, ভয়, শ্রদ্ধা দুই-ই করি। তার নাম কুয়াশা।
কুয়াশা?
মিঃ শরীফ বিস্ময়ে বিমূঢ় হলেন, আপনি স্যার কুখ্যাত বাঙালী দস্যু কুয়াশার কথা বলছেন?
অবিকল তাই। কুয়াশা কখনো হারেনি। তার হাতে বার বার আমিই পরাজিত হয়েছি। কিন্তু আজ কুয়াশা, নেসার কারো নিস্তার নেই।
দলের নেতা হুকুম দেয়।
হঠাৎ কি একটা শব্দে সকলে চমকে উঠে। দলের নেতা দীর্ঘকায় লোকটিও প্রথমে থমকে যায়। তার হাত চকিতে গিয়ে স্থির হয় কোমরের রিভলভারের বটে। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে তার দেরি লাগলো না। এ একটা আকস্মিক ঘটনা মাত্র। শত্রু পক্ষের আক্রমণ নয়, আসলে পিরামিডের পুরনো দেয়ালের একটা পাথর কালের অবক্ষয়ে ধসে পড়েছে।
দলের নেতা হাসলো।
নেসার আহমেদও হাসছিল। প্রচণ্ড অট্টহাসি। সে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজু অ্যামন হোটাপের মর্মর মূর্তির সামনে। রাজা অ্যামন হোটাপ নিষ্ঠুর হাসি হাসছেন। সেই হাসিকে ব্যঙ্গ করে নেসার আহমেদ অট্টহাস্য করে উঠলো। বললো, দোস্ত, আমি কিছু একটা রাজা বাদশা নই। কিন্তু তোমার চেয়ে আমি অনেক শক্তিশালী। ঘন্টা দুই অপেক্ষা করো। তোমার মহামূল্যবান রাজ পোশাক আর চোখের মণি জোড়া নিয়ে তোমাকে সুখী করবো!
হঠাৎ অলৌকিক বিস্ময়ের মতো সেই আচ্ছন্ন আলোময় স্থানে মৃদু টুং টাং ঘন্টা ধ্বনি শোনা গেল। সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের ফিস ফিস কথাবার্তা ও গুঞ্জন। নেসার আহমেদ চমকে ফিরে তাকালো। সতর্ক হয়ে কান পাতলো। শব্দটা ক্রমেই স্পষ্টর হচ্ছে। এ যেন রাজা আমন হোটাপ সপরিষদ দরবারে প্রবেশ করছেন। নেসার আহমেদ সভয়ে ফিরে তাকালো রাজা আমন হোটাপের মর্মর মূর্তির দিকে। দেখলো রাজা অ্যামিন হোটাপ নিঃশব্দে হাসছেন। হঠাৎ দারুণ এসে ছুটতে আরম্ভ করলো নেসার আহমেদ। রাজা অ্যামন হোটাপের শয়ন মন্দির পার হয়ে যেমনি গুহা মুখের উপর উঠতে গেল অমনি নারী কণ্ঠের উন্মাদ খিল খিল হাসি শোনা গেল। সভয়ে পেছন ফিরে তাকালো নেসার। দেখলো নর্তকী জেবা ফারাহ্ দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে। খিল খিল করে হাসছে। জেবা ফারাহ জেবা ফারাহ্ এখানে কেন? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না নেসার। জেবা ফারাহকে সে নিজের হাতে গলা টিপে খুন করেছে। একি তবে জেবা ফারাহর প্রেতাত্মা…
নেসার স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো জেবা ফারাহর দিকে। জেবা ফারাহ্ হাসতে হাসতে বললো, নেসার আহমেদ এখন জেবা ফারাহর হাত থেকে তোমাকে কে, বাঁচায়?
নেসার আহমেদ ভয়ে উত্তেজনায় পিস্তল বের করলো। উন্মাদের মতো গুলি করলো জেবা ফারাহ্র মূর্তির দিকে। আশ্চর্য। ভোজবাজির মতো সেই মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গোল। সারা গুহাময় শুধু কাঁপতে লাগলো জেবা ফারাহয় ভৌতিক হাসি।
নেসার আহমেদ গুহা মুখের পাথর ধরলো। আবার সেই নিঝুম ঘন্টাধ্বনি। হাজার হাজার মানুষের পদচারণার শব্দ, ফিস ফিস গুঞ্জনের স্বর। শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে।
নেসার আহমেদ আর কালবিলম্ব না করে পালাতে চাইলো। পিরামিডের প্রেতাত্মারা যেন ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। মৃত রাজা অ্যামন হেটাপের নির্দেশে প্রতিটি পাথর যেন জিঘাংসায় হিংস্র হয়ে উঠেছে। আর দেরি নয়। অনতিবিলম্বে এই স্থান ত্যাগ করতে হবে।
হঠাৎ কি একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ শোনা গেল। কোনো মানুষের গলায় এই আর্তনাদ সম্ভব নয়। নেসার সভয়ে পেছনে ফিরলো। দেখলো একটা কফিনের ডালা খুলে গেছে। আর তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে বিপুলকায় এক মমি কোনো যাদুমন্ত্র বলে প্রাণ ফিরে পেয়ে। মাটিতে যেন পা চেড়ে গেল নেসারের। এও কি সম্ভব?
বিপুলকায় মমিটা এবারে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মমিটার আপাদমস্তক সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডে জে জড়ানো। হাত দুটি আক্রমণের ভঙ্গিতে সামনে বাড়ানো। বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল নেসারের-ভয়ে কণ্ঠতালু গেল শুকিয়ে। হঠাৎ পাগলের মতো পর পর দুটো গুলি করলো সে মমিটা লক্ষ্য করে। কয়েক মুহূর্তে যেন পাথর হয়ে গেল মমিটা। পরে প্রচণ্ড, গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। দারুণ ক্রোধে থপ থপ পা ফেলে এগোতে লাগলো নেসারের দিকে; নেসার ততক্ষণে পাথর ধরে ফেলেছে। প্রাণপণ চেষ্টায় সে উপরে উঠে গেল। তারপর সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারে ছুটতে লাগলো। এক লাফে পাথর টপকে তার পেছনে পেছনে অন্ধের মতো ছুটলো মমিটা। যেন পিরামিডের ক্ষুধার্ত প্রেতাত্মা আজ কিছুতেই নেসারকে ক্ষমা করবে না।
কোনও ক্ষমা নেই নেসারের।
.
দীবা নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। কুয়াশা নেমে গেছে সুড়ঙ্গ পথে। পিরামিডের সঞ্চিত অর্থ আজ তার আয়ত্তে। অদ্ভুত ক্ষমতাশালী এই কুয়াশা। দীবা আর গোগীকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে হটিয়ে দিয়েছে নেসার আহমেদকে। আর সেই সুযোগে গোগীর পিঠে করে সমস্ত গুপ্তধন নতুন আবিষ্কৃত এক সুড়ঙ্গ পথে লঞ্চে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। নেসারের গুলিতে গোগীর একটা পা ভয়ানক যখম হয়েছে। দরদর করে রক্ত পড়ছিল জখম থেকে-কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুয়াশার সব আদেশ পালন করছে গোগী। পিরামিডের অজস্র ধন-রত্ন, হীরা-মুক্তা, মাণিক্য সাত রাজার ধন এখন কুয়াশার হস্তগত। নেসার আহমেদের মুখের গ্রাস অপরূপ উপায়ে কেড়ে নিয়েছে। কুয়াশা। আশ্চর্য এই লোকটি। দীবা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ভাবলো। পরনে তার নর্তকী জেবা ফারাহর পোশাক। কিন্তু এই পোশাক তার সত্যিকার পরিচয় বহন করে না। দীবার মনে জেবা ফারাহর কোনো দুর্বলতা নেই। দীবার মনে আছে পিরামিডের রহস্যের চেয়ে রহস্যময় ভালবাসা। এই ভালবাসার আবেগ অস্থির হয়ে উঠছে দীবার মনে। কুয়াশার জন্য অপেক্ষা করছে সে। কাল ভোরেই মিশর ত্যাগ করবে তারা। বাংলাদেশে ফিরে যাবে। বাংলাদেশটা নাকি সুন্দর। কতো সুন্দর? কুয়াশার চোখের মতো সুন্দর?