কুয়াশা বেরিয়ে এলো নিজের কেবিন থেকে। ছোট একটা হ্যান্ড ব্যাগ সে তুলে দিলো দীবার হাতে। বললো, এতে প্রয়োজনীয় সব কিছু ভরে দিলাম।
দীবা বললো, যাই এখন।
কুয়াশা বললো, ঐ বাঁকটা ঘরই দেখবে তোমার জন্য আমার গাড়ি অপেক্ষা করছে। তোমাকে কিছু করতে হবে না। ডাইভারকে সব নির্দেশ দেয়া আছে। সে তোমাকে সোজা ইম্পিরিয়াল হোটেলে নিয়ে যাবে।
দীবা বললো, চলি।
কুয়াশা বললো, এসো।
দীবার হাতে হ্যাণ্ড ব্যাগ। পরনে কুয়াশার উপহার দেয়া অত্যন্ত মূল্যবান পরিচ্ছদ। অল্প দোমটা উঠেছে মাথার ওড়নার। ফর্সা মুখে একটা ক্লান্ত অরুণাভা ফুটেছে। দীবাকে বিষণ্ণ অথচ সুন্দর দেখাচ্ছে।
দীবা আস্তে আস্তে চলে গেল। পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। যতক্ষণ দীবাকে দেখা যায় ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আশ্চর্য, দীবা একবারও পেছন ফিরলো না। নদীর তীর ধরে নতমুখে হেঁটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর সে অদৃশ্য হয়ে গেল। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে কুয়াশা আবার নিজের কেবিনে এলো। গতকাল থেকে কেন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করছিল সে। মহুয়ার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় যেমন লেগেছিল মেনি। যাক, তাহলে দীবাও গেল। কুয়াশা এখন মুক্ত। কর্তব্য থেকে মুক্ত, দায় থেকে মুক্ত।
কুয়াশা সিগারেট ধরালো। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। সত্যি কি মুক্ত? বুকের ভিতর ফাঁকা শূন্যতাটুকু তবে কি?
এই প্রশ্নের উত্তর কুয়াশা জানে না। জানার চেষ্টাও সে করলো না। কিন্তু কেন। জানি নিজের অজান্তেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। অনেকক্ষণ পর হঠাৎ এক সময় চোখ তুলে তাকিয়ে সে দারুণ অবাক হয়ে গেল। বললো, তুমি?
হ্যাণ্ড ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে দীবা কান্নায় দুই হাতে মুখ ঢাকলো। বললো, আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না। কিছুতেই যাবো না। আমি ফিরে এসেছি।
কুয়াশার চোখ দুটি সুন্দর এক নতুন পৃথিবী দেখলে।
.
১০.
তখন রাত দশটা! কায়রোর একটা নিষিদ্ধ অঞ্চলে লোক চলাচল শুরু হয়েছে। একজন দীর্ঘকায় মিশরী এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে জনৈকা রূপ জীবনীর দরজায় করাঘাত করলো। অনেকক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দিলো এক বিগত যৌবনা রমণী। কর্কশ কণ্ঠে বললো। কি চাই?
লোকটি হো হো করে হাসলো। বললো, যা সবাই চায়। তোমার ঘরে আসতে চাই।
এখন হবে না। ঘরে লোক আছে। বলে রমণী লোকটি মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করে সে অনেকক্ষণ এক ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা কেমন। যেন চেনা চেনা লাগছে না? ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠলো। সে তার সহচরীকে ডেকে কানে কানে কি বললো। সহচরী মাথা নেড়ে বললো, আমি পারবো না বাপ। পারো তো তুমি গিয়ে বলো।
আহা, না পারলে চলবে কেন? যদি তোর মানুষের বিপদ হয়, তখন?
সহচরী কতক্ষণ কি ভাবলো। আস্তে আস্তে সে পা বাড়ালো ভেতরের দিকে। ভেতরের একটা ঘরে শুয়ে আছে আবদুল্লাহ হারুণ, তার প্রেমিক। আবদুল্লাহ হারুণ ভয়ানক মেজাজী মানুষ। মিশর সরকারের অধীনে সে কি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। কাজের সূত্রেই আবদুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয়। সেই পরিচয় প্রেমে পৌঁছেছে। কিন্তু পরিচয় যত গভীরই হোক, আবদুল্লাহ হারুণ তার কাছে প্রথম পরিচয়ের মতোই রহস্যময় থেকে গেছে। নিজের সত্যিকার পরিচয় সে কিছুতেই খুলে বলে না। প্রায়ই সে বলে তার পিছনে আততায়ী ঘুরছে! সাধারণতঃ এই রকম দুঃসময়ে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেবার জন্য তার ঘরে সে আশ্রয় নেয়। আজও হয়তো বাইরের বিপদ থেকে গা বাঁচাবার জন্যই এখানে সে এসেছে।
সহচরী, নাম কুলসুম, আবদুল্লাহ হারুণের ঘরে ঢুকলো। তাকে সাবধান করে দেয়া দরকার। কিন্তু ঘরে ঢুকেই সে বিস্ময়ে থ হয়ে গেল। কোথায় আবদুল্লাহ হারুণ? পেছনের জানালা ভাঙা। বিছানা তছনছ।
কুলসুম ভয়ে চিৎকার করে উঠলো।
.
আবদুল্লাহ হারুণও তখন চিৎকার করছিল। ভয়ে নয় উত্তেজনায়। তার হাত পা বাঁধা। সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেসার আহমেদ ও কোরবান আলী। কোরবান আলীর হাতে একটা চাবুক।
আবদুল্লাহ হারুণ বলছিল, তোমরা যাই করো, শয়তান; ভেবো না আমাদের হাত থেকে তোমাদের নিস্তার আছে।
কোরবান আলী চাবুকটা বাগিয়ে ধরে সক্রোধে বললো, চুপ বেতমিজ
শান্ত গলায় নেসার আহমেদ বললো, ওকে বলতে দাও কোরবান। ও হলো বেশ্যার দালাল, আর সেই সঙ্গে মিশর সরকারের টিকটিকি। ও যা বলতে চায় বলতে দাও…
আবদুল্লাহ হারুণ বললো, তোমাদের সব আড্ডার হদিশ আমরা জেনেছি নেসার। আমাকে বন্দী করেছে, কিন্তু জেনে রেখো তোমাদের দিনও ফুরিয়েছে।
নেসার আহমেদ কোরবানের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি যা যা বলেছিলাম সব তৈরি আছে কোরবান?
জ্বি হুজুর।
কজন লোক সাথে নিচ্ছো?
দশজন।
অস্ত্রশস্ত্র?
সব ঠিক আছে হুজুর।
প্লেন?
তা-ও তৈরি।
অলরাইট।
নেসার খুশি হয়ে কোরবানের পিঠ চাপড়ে দিলো। বললো আমরা আবদুল্লাহ হারুণের বিচারটা শেষ করেই গুহায় নেমে যাবো। সব কাজ আজ রাতের ভেতরে সেরে পরশুর মধ্যেই দেশে ফিরে যাবো।
আবদুল্লাহ হারুণ উর্দু কথা বুঝছিল না। সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। এবারে তার দিকে মনযোগ দিলো নেসার। শান্ত গলায় ইংরেজিতে বললো, আবদুল্লাহ হারুণ, তুমি আমার দারুণ ক্ষতি করেছে। তুমি আমার হাতে নাফিসা আইভরি ওরফে চম্পাকে বিক্রয় করেছিলে পীসার জন্য। আমি জানতাম না তোমরা দুজনেই ঘৃণ্য কুকুরের দলের। নাফিসা আইভরির রূপ যৌবন দেখে আমি উন্মাদ হয়েছিলাম। তার মাশুল আমাকে শোধ করতে হয়েছে অনেক মূল্য দিয়ে। প্রথমতঃ আমার অতি বিশ্বস্ত প্রহরী আদিল শেখকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়তঃ সেই শয়তান টিকটিকি সিম্পসনকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারলাম না। আবদুল্লাহ, স্বীকার করি তুমি বুদ্ধিমান…আমার দুর্বলতার সুযোগ তুমি ঠিক মতোই নিয়েছিলে।