দীবা খামটা খুললো। পরিচিত সুন্দর হস্তাক্ষরে মিশরীয় ভাষায় মুজাদ্দিদ করীম লিখেছেঃ
প্রিয়তমা,
নানা কারণে তোমার কাছ থেকে আমি দূরে সরে গিয়েছিলাম। আমাকে ভুল বুঝো না লক্ষ্মী মেয়ে। বিশ্বাস করো তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে বিরহের দাবানলে দগ্ধ হয়েছি। এখন আমাদের মিলনের আর কোনো বাধা নেই। আমি সাগ্রহে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। তোমার অভিভাবক শ্রেণীর বাংলাদেশী ভদ্রলোকটি আগামীকল্য আমাদের বিবাহ উৎসবের আয়োজন করেছেন। ইম্পিরিয়াল হোটেলে বাঙালী ভদ্রলোকটির হয়ে তোমাকে আমার কাছে সম্প্রদান করবেন কায়রোর বিখ্যাত ধনপতি শেখ বোরহান সাহেব। শেখ বোরহানের সঙ্গে এ ব্যাপারে সব কথা আলোচিত হয়েছে। আমরা দুজনেই শেষ পর্যন্ত সুখী হতে যাচ্ছি, আল্লাহর কাছে হাজারো শোকর। দুঃখের বিষয় বাঙালী ভদ্রলোকটি আমাদের বিয়েতে নাকি থাকবেন না। যা-ই হোক ব্যবস্থা অনুযায়ী তুমি নিশ্চয়ই আগামীকল্য সকাল সাতটার আগে ইম্পিরিয়াল হোটেলে এসে পৌঁছবে। শেখ বোরহান-এর স্ত্রী কন্যাগণ সামাজিক উৎসবে যা যা করণীয় তা করার জন্যে এবং তোমাকে গ্রহণ করার জন্যে আমার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।
আমার গভীর ভালবাসা জেনো।
ইতি–
তোমারই একান্তভাবে
মুজাদ্দিদ করীম।
দীবা কেবিনের জানালার পাশে বসে রইলো। ঘটনাচক্রে সে একজন অদ্ভুত স্বভাবের লোকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল। কাল থেকে সেই লোকটির সঙ্গে তার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে ভাবলো তার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে কুয়াশা নিশ্চয়ই খুশি। হ্যাঁ, খুশি হবারই কথা। দীবা কুয়াশার জীবনে এসেছিল কর্তব্যের বোঝা হয়ে। ঘটনাচক্রের দায় হয়ে। কাল থেকে কুয়াশা কর্তব্য ও দায় থেকে মুক্ত। এবারে সে নিশ্চিন্তে নেমে যাবে তার কাজে। পিরামিডের অতল রহস্যের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কুয়াশার বুকে জ্বলবে হত্যাকারীর জিঘাংসা। হাতের মুঠোয় থাকবে নিষ্ঠুর আক্রমণ। আর দুচোখ মেলে দেখবে সে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান সাধনার স্বপ্ন।
আশ্চর্য, দীবা ভাবলো। লোকটা কি অদ্ভুত। গুপ্তধনের লোভে সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছে রহস্য নগরী কায়রোতে। কিন্তু কুয়াশার লোভ কি শুধু ধন-রত্নেই? শুধু মণি-মানিক? একটি সুন্দরী নারীর সান্নিধ্য কি তাকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি? প্রেম, ভালবাসার কণামাত্র অনুভূতি হৃদয়ে জাগিয়ে দিতে পারেনি?
সম্ভবতঃ পারেনি। দীবার চোখ ভুল করে না। কুয়াশাকে সে চিনেছে। কুয়াশা সেই প্রকৃতির পুরুষ, যার ভালবাসা গভীর সমুদ্রের মতো। যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন নির্জন, শান্ত। যখন জেগে ওঠে তখন প্রলয়ের মতো ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় ভয়ঙ্কর। যুগে যুগে নারীদের কাছে এই ভালবাসাই আকাঙিক্ষত হয়ে এসেছে। কিন্তু দীর দুর্ভাগ্য যে সে কুয়াশার সাগর মনে এতটুকু দোলা জাগাতে পারলো না।
টপ টপ করে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো দীবার চোখ থেকে। দীবা সচকিত হলো। চোখ মুছে হাসলো। আশ্চর্য, সে কি তবে এতদিন কুয়াশার ভালবাসার জন্য উন্মুখ ছিলো? কারো জন্যে বেদনার অনুভব, কাউকে জীবন দিয়ে সুখী করার অন্তর, সুখ ও আনন্দ বিসর্জন দিয়ে কাউকে চাওয়ার নামই কি ভালবাসা? আশ্চর্য! দীবা ভাবলো। এতদিন এই বেদনা, এই সুখ, এই মর্মমথিত দীর্ঘশ্বাস কোথায় ছিলো।
দীবা নিঃশব্দে বাইরে এলো। আকাশে অসংখ্য তারা। বাতাস বইছে। ঘুমন্ত পৃথিবী।
হঠাৎ রাতের নির্জনতা ভরে উঠলো সরোদের কান্নায়। কুয়াশা সরোদ বাজাচ্ছে। দীবা সঙ্গীতের ধর্ম বোঝে না। কিন্তু সরোদের বাজনা শুনে তার মনে হলো যে কথা বলার উপায় নেই, যে কথা কথা দিয়ে প্রকাশ করা যায় তা সঙ্গীতের ভাষা।
তার ইচ্ছে করলো কুয়াশার কাছে গিয়ে বসে। বসে কুয়াশার তন্ময়, সুন্দর চোখ দুটি দেখে। কিন্তু ইচ্ছে সে দমন করলো। সম্পর্কের সূত্র বাড়িয়ে লাভ নেই। রাত পোহালেই দাবা চলে যাবে বহুদুরে। সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে একটি নতুন জীবন।
সে ভাবলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেবে। ঘুমোবার জন্য সে ঘরে গেল। বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে ঘুমোতে চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম এলো না। রাত ভরে গেছে সরোদের কান্নায়। সময় এগিয়ে আসছে বিদায় নেবার। সে আবার বাইরে এলো। দাঁড়িয়ে রইলো কেবিনের রেলিং ধরে।
একটা একটা করে আকাশের তারাগুলো নিভে আসছে! একটু একটু করে হাওয়ার বেগ বাড়ছে। দূরের মরুভূমি, পাহাড় আর কায়রো নগরীর আলোকোজ্জ্বল দিগন্ত হারিয়ে যাওয়া কোনো অতীতের মত লাগছে। দীবা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। মানুষের মন কি নির্দয় প্রতারক। এতকাল যার জন্যে দীবাস্বপ্ন দেখলো, কতক্ষণ আগেও কি দীবা জানতো সে একটা অর্থলোভী সুযোগ সন্ধানী বই কিছু না? অর্থের লিপ্সায় দীবার সঙ্গে সে বাগদত্তা হয়েছিল অর্থই তাকে আবার তার কাছে ফিরিয়ে এনেছে। না, দীবা নিজের প্রায়শ্চিত্ত নিজে করতে তীতা নয়। সে মুজাদ্দিদ করীমের কাছেই ফিরে যাবে। ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবে সারা জীবন দিয়ে। এছাড়া করার তার আর কি রইলো?
ধীরে ধীরে রাত্রি প্রভাত হলো। কখন যেন কুয়াশার, সরোদ থেমে গেছে। দীব কেবিনে গিয়ে প্রস্তুত হয়ে ফিরে এলো। চারদিকে আবছা, কোমল আলো। ঝির ঝির ঠাণ্ডা বাতাস। নদীর বুকে ঢেউ উঠেছে। ঢেউয়ের মাথায় চকিত শুভ্রতা। দীবা আকাশের দিকে তাকালো। একটি মাত্র তারা এখন আকাশে জ্বলছে। শুকতারা। কিছুক্ষণ বাদে এই তারাটিও দিনের প্রথম তাপে নিভে যাবে। হাতঘড়ি দেখলো সে। সাতটার দেরি কতো?