দীবা সারাদিন কেবিনে শুয়ে বসে কাটিয়েছে। একবার শুধু গোগীকে দেখতে গিয়েছিল। গোগী ডেকের নিচে শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় ছিলো। গোগীকে দেখে মনে হচ্ছিলো শৃঙ্খলাবদ্ধ হওয়ার জন্যে সে খুব অপমানিত বোধ করছে। দীবাকে দেখে তার চোখ মুখ অভিমানে রীতিমত ভারি হয়ে উঠলো। সে একবার মাত্র দীবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। ভাবখানা, দেখলে মেম সাহেব, আমাদের সাহেবের কাণ্ড টা? লোহার শিকল দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছেন, যেন আমি ছাড়া থাকলে পালিয়ে যেতাম! আরে, পালিয়ে যাবার ইচ্ছে থাকলে এই গোগীকে কেউ ফেরাতে পারতো? তেমন শক্তি কারো আছে?
দীবা গোগীকে দেখলো। ভয়ঙ্কর দর্শন গরিলা। কিন্তু কুয়াশার সম্মোহনে তার বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। গোগীর ঝুলানো ঠোঁটে আর ঝিমানো চোখে অভিমানের ছায়া দেখে দীবা একটু না হেসে পারলো না। গোগী অমনি সচকিত হয়ে তাকালো। দীবার মনে হলো গোগী যেন বলতে চায়, দোহাই মেম সাহেব, সাহেবকে যেন সব কথা বলো না। আমার কথা ছেড়ে দাও। মুখ্য সুখ্য জীব। কি না কি বলছি ঠিক আছে? তাহলে মেম, সাহেব, বলো না কিন্তু, হ্যাঁ? সাহেব রেগে গেলে আমার সঙ্গে যা মেজাজ দেখান, ভয়ে আমি বাঁচি না। না বাপু, আমি বরং এই রকম আর করবো না।
গোগীকে আদর জানিয়ে দীবা আবার কেবিনে ফিরে এসেছে। বলতে গেলে সারাদিন সে কিছু করেনি। অবচেতন মনে কুয়াশার জন্যে অপেক্ষা করছে। দুপুর তেল, বিকেল গেল, সন্ধ্যাও যায় যায়। কোথায় কুয়াশা?
কুয়াশা ফিরলো গভীর রাতে। ক্লান্ত দীবা তখন জানালার পাশে বসে নির্জন রাত দেখছে। নীল-নদের হাওয়ার শব্দ শুনছে। কুয়াশা হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ালো। এ সেই কুয়াশা যে সরোদ বাজায়, যে ভোর সকালের উদ্ভাস দেখে তন্ময় হয়ে যায়।
দীবা বললো, এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো বুঝি?-বলেই বুঝলো কথাটা বেমানান হয়েছে।
কুয়াশা প্রথমটায় বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সপ্রতিভ হলো পরমুহূর্তে। বললো, আমি জানতাম না তুমি রাত জেগে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। নিশ্চয়ই কষ্ট দিয়েছি খুব।
দীবা কথা বললো না। কিন্তু মুজাদ্দিদ করীমের সংবাদ জানার জন্যে ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
কুয়াশা বললো, আজ আমার আনন্দের দিন দী। আমি কথা দিয়েছিলাম তোমাকে সাহায্য করবো। আমার চেষ্টা সফল হয়েছে। মুজাদ্দিদ করীম কোটিপতি ধনী আল গাফরানের কন্যা নাঈমার সঙ্গে বাগদত্তা ছিলেন। সব কথা বুঝিয়ে বলার পর তিনি আবার তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন। মুজাদ্দিদ করীম এখন জানেন তুমি আর নিঃস্ব দীবা ফারাহ নও। এখন তোমার অনেক অর্থ। অনেক সম্মান ও প্রতিপত্তি। তিনি আনন্দের সঙ্গেই তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন।
দীবা প্ৰথমটায় আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠলো। পর মুহূর্তে একটা আশঙ্কার খোঁচায় বিমূঢ় হলো। তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। বললো, কিন্তু আমার অর্থ আছে, সম্মান আর প্রতিপত্তি আছে এসব তো মিথ্যে! তুমি মুজাদ্দিদ করীমকে যা সত্য নয় তা দিয়ে ভোলাতে গেলে কেন কুয়াশা?
মিথ্যে আমি বলিনি দীবা। এই নাও ব্যাঙ্কের চেক ও পাবুক। তোমার নামে ব্যাঙ্ক অফ ইজিপ্টে তিরিশ কোটি টাকা জমা হয়েছে। তুমি যাতে পিরামিডের অর্থ অপহরণের দায়ে না পড়ে তার ব্যবস্থাও আমি করে দিয়েছি। টাকাটা আমার হয়ে তোমাকে দিয়েছেন আমার এক মিশরীয় বন্ধু শেখ বোরহান।
দীবার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। বুকের ভেতর উথলে উঠলো নাম না জানা এক আবেগ। সে বলতে চাইলো, না, না এ টাকা আমি চাই না। মিথ্যে পরিচয়ে আমি সুখী হতে পারবো না। কিন্তু কিছুতেই সে কোন কথা বলতে পারলো না। অপলক নেত্রে সে তাকিয়ে রইলো কুয়াশার দিকে। এতবড় দান কেন করতে গেল কুয়াশা। এতদিনে তার মনে হয় কুয়াশা নিষ্ঠুর কুয়াশা বিপজ্জনক।
কুয়াশা দীবার মনের ভাব টের পেলো না। সে পকেট থেকে একটা খাম বের করলো। বললো, আমাকে তোমার পুরস্কৃত করা উচিত দীবা। আমি মজাদ্দিদ করীমের কাছ থেকে তোমার চিঠি বয়ে নিয়ে এসেছি। এই নাও।
দীবা চিঠি হাতে নিলো। কুয়াশা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। বললো, ভোর রাতে তোমার যাবার ব্যবস্থা ঠিক হয়েছে। সকাল সাতটার ভেতর মুজাদ্দিদ করীম কায়রোর ইম্পিরিয়াল হোটেলে তোমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আশা করি তুমি প্রস্তুত।
মাথা নাড়লো দীবা। বললো, হ্যাঁ আমি তৈরি।
কুয়াশা এরপর কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।
খামটা নিয়ে অনেক্ষণ দীবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। খোলা বাতাসে তার মাথার চুল কাঁপছিল। অন্ধকার ও আলোর ছায়া কাঁপছিল চোখে মুখে। তার মনে পড়ছিল মুজাদ্দিদ করীমের সুন্দর মুখচ্ছবি। প্রথম যৌবন থেকে এই সুন্দর মুখচ্ছবি দীবার জীবনের স্বপ্ন। জেবা-ফারাহ যদি রাজকুমারী আয়িদার নক্সা চুরি না করতো তাহলে তার বাবা আত্মহত্যা করতেন না। তাদের জমিদারী ও প্রাসাদ বাজেয়াপ্ত হতো না। হয়তো এতদিন মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে তার সম্পর্ক মিলনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছতো। সেই স্বপ্ন এতকাল ছিলো দুঃস্বপ্ন। এতকাল বিরহের আগুনে দীবা দগ্ধ হয়েছে। জীবনে হতাশ হয়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে গিয়েছিল। এসবই ছিলো মুজাদ্দিদ করীমের জন্য। সুন্দর স্বপ্নের মতো সেই মুজাদ্দিদ আবার ফিরে এসেছে দীবার জীবনে। দীবার চেয়ে সুখী আর ভাগ্যবতী কে আছে?