মাত্র কয়েক গজ দূরে রিভলভার হাতে হঠাৎ শহীদকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিল লোক দুজন, কিন্তু এক মুহূর্তে সামলে নিয়ে দুই লাফে শহীদের ফোক্সওয়াগেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা। তারপর এক ঝটকায় দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসলো।
খবরদার! একটু নড়াচড়া করলেই গুলি করবো। গর্জে উঠলো শহীদ।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। গাড়ির এঞ্জিন ততক্ষণে স্টার্ট হয়ে গেছে। নিজের গাড়ির ওপর গুলি ছুঁড়তে এক সেকেণ্ডের জন্যে একটু দ্বিধা হলো শহীদের। আর সেই সুযোগে চোখের সামনে দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় পড়লো শহীদের গাড়িটা এবং পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টিপথ থেকে। পাঁচ সেকেণ্ডে চল্লিশ মাইল স্পীড উঠে গেল।
ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেল যে মনে মনে এদের অনায়াস দক্ষতা এবং পেশাদারী ক্ষিপ্রতার প্রশংসা না করে পারলো না শহীদ।
এবার ফিরে চাইলো শহীদ আহত লোকটার দিকে। কামালও ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ছুরিটা পিঠের ওপর থেকে টেনে বের করতেই কল কল করে তাজা রক্ত বেরিয়ে এলো। সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে সেঁটে গেল গায়ের সঙ্গে। শহীদ বুঝলো, এ লোক বাঁচবার নয়।
দেহটা ঘুরিয়ে লোকটার চেহারা দেখে একসাথে চমকে উঠলো শহীদ আর কামাল। অস্ফুট উত্তেজিত কণ্ঠে শহীদ বললো, আরে এ যে কাফ্রী খোদাবক্স?
সেই মিশরীয় নর্তকী জেবা ফারাহ-র দেহরক্ষী না?
হ্যাঁ! ধরো তো আমার সঙ্গে, ঘরের ভেতরে নিয়ে যাই।
খোদাবক্সের দুই কশা বেয়ে তখন ফেনা বেরোচ্ছে। একটা অস্বাভাবিক ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে ওর গলা দিয়ে। ঘরের মধ্যে আনা হলে হঠাৎ জ্ঞান ফিরে এলো ওর। সমস্ত মুখটা বিকৃত হয়ে গেল কিসের এক আতঙ্কে। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে মার্বেলের মতো চোখ দুটো। দুই হাত শূন্যে তুলে কি যেন ঠেকাবার চেষ্টা করছে সে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শিরা বের করা দুহাত। পালিয়ে বাঁচবার জন্যে একবার হামাগুড়ি দেবার চেষ্টা করে আবার পড়ে গেল সে মেঝেতে। এক হাতে পুরু কার্পেটের একটা অংশ খামচে ধরলো খোদাবক্স। মিশরীয় ভাষায় অস্পষ্ট ভাবে কয়েকটা শব্দ বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে। তারপরই একবার হিক্কা তুলে স্তব্ধ হয়ে গেল চিরতরে।
.
০২.
হ্যালো! কে, শহীদ বলছে? মি. সিম্পসনের বিস্মিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
হ্যাঁ। কামালের বাসা থেকে আপনাকে রিং করছি। এক্ষুণি একটু আসতে পারবেন এখানে?
ব্যাপার কি?
এসেই না হয় শুনবেন! কি জানো, প্রেসিডেন্টের দেশ সফর নিয়ে সারা অফিসে মহা হট্টগোল চলছে। আমি এই মুহূর্তে বেরোতে পারবো না কিছুতেই। তোমার প্রয়োজনের একটু আভাস যদি দিতে পারো তবে উপযুক্ত লোক পাঠাবার।
বুঝতে পেরেছি। তবে প্রয়োজনটা আমার নয়, আপনাদেরই। সেটা হচ্ছে এই যে, জেবা ফারাহ-র কাফ্রী দেহরক্ষী খোদাবক্সের মৃতদেহ আমরা আগলে বসে আছি এখন, কামালের ড্রইরূমে। আর আধ ঘন্টা রাখতে পারবো। উপযুক্ত লোক পাঠালে এর মধ্যেই পাঠান।
বলো কি শহীদ! খোদাবক্সকে খুন করলো কে? আর তার কারণই বা কি?
কে করেছে তা আমি জানি না, জানতে চাই-ও না। তবে কারণটা হচ্ছে, আমার যতদূর বিশ্বাস, ওর কোমরে বাঁধা একটা রূপোর কবচ।
হেঁয়ালি রেখে একটু পরিষ্কার করে বলবে?
অতো সময় নেই। আর টেলিফোনে সব কথা জানানো সম্ভবও নয়। খুব তাড়াতাড়ি লোক পাঠান, আমাদেরও প্রাণ সংশয় আছে।
ঠিক আছে, আমি এক্ষুণি লোক পাঠাচ্ছি। আর আজ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে এদিকে কাজ সামলে আমি তোমার বাসায় গিয়ে সব শুনবো। কেমন? সি ইয়ু!
শহীদ উত্তরে সি ইয়ু বলবার আগেই রিসিভার ছেড়ে দিলেন সরকারী গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ কর্মচারী মি. সিম্পসন। দুএকটা কথাতেই সবটা বুঝে নিয়েছেন, তিনি। শহীদও নিশ্চিন্ত মনে এবার একটা টেল ল্যাম্পের নিচে মেলে ধরলো খোদবক্সের কোমরে বাঁধা কবচের মধ্যে থেকে বের করা এক টুকরো ট্রেসিং পেপার। বিচিত্র আঁক-ফোক দেয়া আছে কাগজটার উপর। চট করে শহীদের মাথায় খেলে গেল, এটা নিশ্চয়ই গুপ্তধনের নক্সা। আসল নক্সা থেকে এই ট্রেসিং পেপারের ওপর নকল তুলে নিয়ে আসলটা বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। তবে কি কুয়াশা নেসার আহমেদের কাছ থেকে যে নক্সাটা ছিনিয়ে নিয়ে মিশরের পথে উধাও হয়ে গেল সেটা সেই ভুল আঁক দেয়া নক্সা ব্যাপার কি খোদাবক্সই বা আজ সন্ধ্যার পর এদিকে আসছিল কি করতে পেছনে লোক লেগেছে টের পেয়েই কি খোদাবক্স আসছিল শহীদ বা কামালের সাহায্য গ্রহণ করতে।–যারা একে খুন করলো তারা কি নেসারের সোক
থাক, এতো মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। য়ে জীবন থেকে সরে এসেছে সে আর সেপথে পা বাড়াবার কোনও দরকার নেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নক্সাটা আবার উজ করে রূপোর চৌকোণা মাদুলির ভিতরে ভরে রাখলো শহীদ।
কামাল গিয়েছিল বাড়ির ভিতরটা সামলাতে। ফিরে এসে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে রাখলো অন্দর মহলের-তারপর সোফার ওপর বসলো, সন্তর্পণে যেন গম্ভীর চিন্তামগ্ন শহীদের ধ্যান ভঙ্গ না হয়।
খট করে একটা শব্দ হতেই চমকে ফিরে কামাল দেখলো শহীদের রনসন ভ্যারামে গ্যাস লাইটারের ক্ষুদ্র চোয়ালটা হাঁ হয়ে গেছে-আর তার থেকে অগ্নি পান করছে কিং সাইজের একখানা পলমল সিগারেট। খোদবক্সের নিষ্প্রাণ মুখটা পালিশ করা আবশ কাঠের মূর্তির মতো মনে হচ্ছে।