মি. সিম্পসন শুধু এক মুহূর্তে নেসার আহমেদের বিশ্বাসী ভৃত্য হতভাগ্য আদিলের দিকে ফিরে তাকালেন। তাঁর দুঃখ লাগছিল। কিন্তু ভাবালুতায় সময় নষ্ট করবার বিপদ তিনি জানেন। আর দেরি না করে তিনি এগিয়ে যান। নাফিসাকে অনুসরণ করে তিনি গুহামুখে এলেন। নাফিসা বললো, তাহলে বিদায়, সিম্পসন।
গুডবাই কাইণ্ড লেডি!
মি. সিম্পসন মাথা নোয়ালেন।
অতর্কিতে একটি অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়লো। কোরবান আলীর নিষ্ঠুর মূর্তি দেখা গেল দ্বারপ্রান্তে। চকিতে একটা তীক্ষ্ণ একফলা ছুরি গিয়ে বিধলো নাফিসার বুকে। তীব্র চিৎকারে লুটিয়ে পড়লো নাফিসা। মি. সিম্পসন ঝট করে এক পাশে সরে গিয়ে কোরবান আলীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লেন।
গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ভয়ঙ্কর অট্টহাসি শোনা গেল কোরবান আলীর।
ইতর টিকটিকি, আমার হাতে আজ তোর রক্ষা নেই।
নাফিসা কাতর কণ্ঠে বললো, মি. সিম্পসন, এই মুহূর্তে আপনি বেরিয়ে যান। এখনো সময় আছে মি. সিম্পসন-প্লিজ, প্লিজ।
কিন্তু মি. সিম্পসন নাফিসার মৃতদেহ পেছনে রেখে কিছুতেই যাবেন না। তার চোখ-মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। দেয়ালের এপাশে সরে এসে তিনি পর পর দুটো গুলি ছুড়লেন। ভেতর থেকে কাতর কণ্ঠ শোনা গেল। কেউ আহত হয়েছে। সোরগোল পড়ে গেছে গুহায়। বিপদ সঙ্কেত বেজে উঠলো। আর দেরি করলেন না মি. সিম্পসন। নাফিসার দেহ কাঁধে তুলে অন্ধ বেগে ছুটে গেলেন গুহামুখে। গুহামুখ বন্ধ। দুজন প্রহরী ছুটে আসছে। মি. সিম্পসন আবার গুলি ছুড়লেন। গুলি খেয়ে একজন প্রহরী মেঝেয় লুটিয়ে পড়লো। আর একজন দেয়ালের খাঁজে আত্মগোপন করলো।
প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে আরও কয়েকজন লোক। মি. সিম্পসন বুঝলেন আর যুদ্ধ করে ফল নেই। মৃত্যু এবারে অবধারিত। তার হাতের পিস্তলে আর মাত্র একটি গুলি আছে। রুদ্ধ গুহামুখে এক মুহূর্তের জন্য তিনি দাঁড়ালেন। তার কাঁধের উপর ছুরিকাবিদ্ধ মুমূর্ষ নাফিসা। রক্তে মি. সিম্পসনের জামা-কাপড় রঞ্জিত। শেষ চেষ্টায় তিনি গুহামুখের বিশালকায় পাথরে সর্বশক্তিতে ঠেলা দেন। গুহা মুখ তেমনি অচল, অনড় হয়ে রইলো!
অস্পষ্ট, জড়ানো গলায় নাফিসা বললো, দেয়ালের ঐ বোতামে টিপ দিন মি. সিম্পসন। প্লিজ, দেরি করবেন না।
মি. সিম্পসন তাই করলেন। অবশেষে মুক্তির পথ উন্মুক্ত হলো সামনে। পেছনে। ছুটে আসছে নিষ্ঠুর আততায়ীরা। মি. সিম্পসন গুহামুখ থেকে বেরিয়ে মরুভূমির ভেতর ছুটতে লাগলেন। অন্ধকার থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন আলোর পৃথিবীতে, মৃত্যু পার হয়ে এসেছেন জীবনে। আর ভয় নেই।
তিনি ছুটতে লাগলেন। আবছা অন্ধকার রাত্রিতে তিনি হারিয়ে গেলেন রহস্যময় মরুভূমির বুকে।
.
০৯.
দীবা দাঁড়িয়েছিল কেবিনের বারান্দায়। নীল নদে ভাসমান লঞ্চটি সন্ধ্যার বাতাসে একটু একটু দুলছে। বহুদূরে দেখা যায় বালিয়াড়ির দিগন্ত। আকাশের দিকে তাকায় দীবা। আকাশটা যেন কোনো খেয়ালী শিল্পীর ক্যানভাস। নানা রঙে রঞ্জিত। দীবার মন চিন্তাকীর্ণ। সারাদিন সে শুয়ে শুয়ে কাটিয়েছে, তার শরীর দুর্বল, অবসন্ন। কুয়াশা সেই যে ভোরবেলা বেরিয়েছে, এখনো ফেরেনি। রোগীকেও নিয়ে যায়নি। শুধু তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা কাগজে গোটা কতক সই করিয়ে নিয়ে গেছে দীবাকে দিয়ে। পিরামিডের গোলক ধাঁধা থেকে মুক্তি পাবার পর কুয়াশা কিছুতেই আগের মতো সহজ, স্বাভাবিক হয়নি। সর্বদাই তার চোখ দুটি জ্বলন্ত। মুখে উত্তেজনার রক্তিম রঙ। ভোর সকালে বেরোবার সময় দীবা দাঁড়িয়েছিল খোলা ডেকে। সে জিজ্ঞেস করছিল, কোথায়। যাচ্ছো?
কুয়াশার চোখ দুটি কৌতুকে ভরে উঠেছিল। বলেছিল, বর খুজতে।
কার জন্যে?
কুয়াশা এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। একটু হেসে বলেছিল, যা তা বর নয় দীবা। দামী বর। নাম শুনবে? মুজাদ্দিদ করীম। দীবা কি একটা বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি। কুয়াশা একটা দামি সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ টানছিল। আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কুয়াশার এই রূপটি ভারি সুন্দর। দীবা দেখেছে সরোদ বাজাবার সময় কুয়াশার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে শিল্পীর গভীর তন্ময়তা। একটা আলোময় দ্যুতি খেলা করে মুখমণ্ডলে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে এই লোকটাই হিংস্র ডাকাত, ভয়ঙ্কর নর হত্যাকারী। জেবা ফারাহ্ সুদূর মিশরে বসেই বাংলাদেশের এই লেকিটিকে এক নম্বরের শত্রু জ্ঞান করতো। খুনে ডাকাত নেসার আহমেদ এরই ভয়ে কম্পিত। একই মানুষের দুটো চেহারা ভাবতে অবাক লাগে।
চুপচাপ, সিগারেট টানছিল কুয়াশা আর আকাশের দিকে তাকিয়ে তনয় হয়ে গিয়েছিল। দীবা আস্তে আস্তে বলছিল, মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছে?
হয়েছে। লোকটা অদ্ভুত সুন্দর। আমার লোভ হয়-আমি যদি অমনি সুন্দর হতে পারতাম!
কুয়াশা আর কিছু বলেনি। একবার তাকিয়েছিল দীবার দিকে। তখন আফ্রিকার ভয়ঙ্কর সুন্দর সূর্য পূর্ব আকাশে রক্তিম হয়ে উঠছে। বুনো পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। ডোঙ্গার মাঝি নীল নদে নৌকা ভাসিয়ে দিন আরম্ভ করেছে।
দীবার চোখের সামনে কুয়াশার দীর্ঘ, বলিষ্ঠ মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ খোলা ডেকে বসে দীবা ফিরে গিয়েছিল নিজের কেবিনে। তার শরীর দুর্বল, মন অবসন্ন। পিরামিডের রহস্যময় গোলক ধাঁধায় সে মৃত্যুর চেহারা স্পষ্ট দেখে এসেছে। উপলব্ধি করেছে সে যেন পুনর্জীবন নিয়ে ফিরে এলো। কিন্তু এই জীবন আবার কোন পথে মোড় নিতে যাচ্ছে?