অন্ধকার সুড়ঙ্গে পথ চলতে গিয়ে বার বার হোঁচোট খেলো দীব। সঙ্কীর্ণ দেয়ালের নিচে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করলে মাথা ঠুকে যায়। দেয়ালের কন্দরে কন্দরে লুকিয়ে আছে জিঘাংসার নানা অভিসন্ধি। কিন্তু কিছুই তাকে টেনে রাখতে পারছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে পথ চলছিল। জেবা ফারাহর লোভের ধিকিধিকি আগুন যেন দাবার মনেও সংক্রামিত হয়েছে। অন্ধকার মৃত্যুগহ্বরে হাজার হাজার বছরের সঞ্চিত ধন-রত্ব যেন দীবারও চাই। পিরামিডের নিচে এসে সব সে ভুলে গেছে। একটা মাত্র উদ্দেশ্য তাকে টেনে নিয়ে চলেছে। মমি, রাজার ধন। নর্তকী জেবা ফারাহ্র রক্ত যেন দীবার শিরায় শিরায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
অবশেষে সুড়ঙ্গ পথ এসে একটা প্রাচীরে শেষ হয়ে গেল। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দীবা। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না।
কতক্ষণ এভাবে গেল সে জানে না। এক সময় দেখলো, পিছনে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোগী। দীবা সচকিত হয়। সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কান পেতে শুনলো প্রাচীরের পাথরে পাথরে একটা ক্ষীণ শব্দের তরঙ্গ বেজে উঠছে। শিউরে উঠলো দীবা। অপেক্ষা করলো একটা ভয়ানক কিছুর জন্য। কিন্তু কিছুতেই ঘটলো না ভয়ঙ্কর কিছু। শব্দ তরঙ্গ থেমে গেল একটু পরেই। অন্ধকার পিরামিডের তলায় দীবা দাঁড়িয়ে রইলো কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে।
গোগী…
দীবা যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য অসহায় ভাবে গোগীর সহযোগিতা কামনা করলো। কিন্তু ডাক শুনে তোগী একটু চঞ্চল হলো মাত্র। তার ভাঁটার মতো দুটি জ্বলন্ত চোখে উত্তেজনা ফুটলো। তারপর সময় তেমনি কাটতে লাগলো। পিরামিডের পাথর অচল অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দীবা পাথরে হাত রাখলো। মাথা রাখলো। যেন এই ভয়ঙ্কর, অচল প্রাচীরের কাছে সে আত্মসমর্পণ করলো। কতক্ষণ সে চোখ বুজে এইভাবে ছিলো জানে না। এক সময় ক্লান্ত চোখ নিয়ে তাকালো। পাশ ফিরলো। হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলো। কিন্তু মুহূর্তেই সামলে নিলো নিজকে। দেখলো বাঁ পাশে একটি সোনালি রঙের সিংহ মূর্তি। সেই মূর্তির পেছন দিকে রয়েছে ভেতরে যাবার সঙ্কীর্ণ পথ। যেন মুহূর্তে হারানো জীবন ফিরে পেলো দীবা। এগিয়ে গেল সে। সঙ্কীর্ণ পথে পা দিলো। হঠাৎ কি হলো সে জানে না। প্রথমে হোঁচট খেলো, পরে গড়িয়ে পড়লো সিঁড়ি বেয়ে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় একটা অসহ্য ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। পিরামিডের গভীর অন্ধকার তার চারদিকে ঘনিয়ে উঠলো। দীবা মূৰ্জিত হয়ে পড়লো।
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজের চোখকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলো না। দেখলো পরম বন্ধুর মতো তার শিয়রে বসে আছে কুয়াশা। সে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো। কুয়াশা তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিলো। ইঙ্গিতে নিষেধ করলো। হাত দিয়ে পাশের একটি অলিন্দ দেখিয়ে কিছু একটা বোঝাবার চেষ্টা করলো। দীবা সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা অনুভব করছিল। কিন্তু শারীরিক পীড়ার কথা তার এই মুহূর্তে মনে রইলো না। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
রকমারি রঙিন আলোর ছটা এসে পড়েছে একটু দূরে। চারদিকে পাথর, উঁচু স্তম্ভ ও দেয়াল। মাঝখানটা ফাঁকা। রঙিন আলোর ছটায় সেই স্থানটা স্বল্পালোকিত। দীবা দেখলো সেই স্বল্লালোকিত স্থানে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। কাঁধে একটা বিড়াল। রাজ পোশাক পরিহিত সেই লোকটার নাসিকা তীক্ষ্ণ। চোয়ালের গঠন নিষ্ঠুর স্বভাবের পরিচয় বহন করে। লোকটার অভিব্যক্তিতে একটা অতিকায় হিংস্র হাসি ফুটে আছে।
কুয়াশা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিলো বুঝি সুমুখের স্বল্পালোকিত স্থানে এখনই কোনো নাটকীয় ঘটনা ঘটবে। হলোও তাই। বিপরীত মুখের অন্ধকার প্রাচীর থেকে মশাল হাতে একটা লোক বেরিয়ে এলো। লোকটা দীর্ঘ বলিষ্ঠ। এগিয়ে এসে রাজ পোশাক পরিহিত লোকটার সামনে দাঁড়ালো। মশালটা উঁচিয়ে ধরলো মুখের সামনে। তারপর প্রচণ্ড অট্টহাস্য করে উঠলো।
বললো, রাজা অ্যামন হেটাপ! মরে গিয়েও তোমার স্বস্তি নেই। যক্ষ হয়ে রাজ কোষ পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু এবারে আমি তোমাকে মুক্তি দেবো দোস্ত। আর মাত্র তিন দিন অপেক্ষা করো।
একটা প্রমোট নির্জনতা থমথ করে উঠলো। মশালের লাল ছায়া দেয়ালে দেয়ালে। সাপের জিহ্বার মতো লক লক করে উঠলো। লোকটা মশাল নামিয়ে এক মুহূর্ত কি ভাবলো। তারপর পাশের আর একটা অন্ধকার প্রাচারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বহুক্ষণ নিঃশব্দে কাটলো। দীবা তাকালো কুয়াশার দিকে। কুয়াশা দীবার মাথায় হাত রাখলো। একটু হাসলো। বললো, দীবা, তুমি আমি দুজনেই দৈব দুর্বিপাকে এখানে এসে পড়েছি। সামনে মন্দিরটি দেখছো? রাজা অ্যামন হোটাপের মন্দির। তোমার বোন জেবাহ ফারাহ্ যে ধন-রত্নের জন্য আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছে, সেই ধন-রত্ন পোঁতা রয়েছে ঐ মন্দিরে।
একটু থামলো কুয়াশা। বললো, ঐ যে স্তব্ধ রাজমূর্তিকে দেখছো, সেই রাজমূর্তি রাজা আখতানের পিতামহ রাজা অ্যামন হোটাপের। মন্দির থেকে এই গুহায় ঢুকে আমি ঐ নিষ্ঠুর অবিচল মূর্তিটা দেখে বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম।
একটু হাসলো কুয়াশা। বললো, অল্পের জন্য আমরা বেঁচে গেছি দীবা। আমি উন্মাদের মতো ধন-রত্ন কুড়িয়ে বেড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দ একটা ভারি বস্তু ওপর থেকে নিচে এসে পড়লো। আমি চেতনা ফিরে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখি তুমি। তোমাকে ধরে তুলতেই আবার বিপদ সঙ্কেত। দেখলাম গুহার প্রবেশ মুখের পাথর ধীরে ধীরে নড়ছে। বুঝলাম বিপদ আসন্ন। তাড়াতাড়ি সরে এসেছি প্রাচীরের এই প্রান্তে।