নেসার আহমেদ যদি খুনে ডাকাত হয় তাহলে আমি আর সাধু হলাম কিসে সাহেব?
প্রহরীটা হাসে। বলে, ওসব লোভ দেখাবেন না আমাকে। লাভ হবে না কিছু।
মি. সিম্পসন মনে মনে অশিক্ষিত, ভয়ঙ্করদর্শন প্রহরীর প্রশংসা না করে পারেন না। ন্যায়ের পথ আছে ডাকাতেরও আছে ধর্ম। এই প্রহরী তার স্বধর্ম রক্ষা করছে। নেসার আহমেদ লোকটা ভাগ্যবান।
তিনি আর কিছু বলেন না। প্রহরী নিঃশব্দে দরজার দিকে চলে যায়। স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সিম্পসনের ঘুম ভাঙে, সময় কাটে। বন্দী দশায় কদিন গেল এই হিসাবও তার মনে নেই। একদিন দরজার গোড়ায় উচ্চকণ্ঠে হাসি শোনা গেল। সচকিত হলেন মি. সিম্পসন। ভেতরে ঢুকলো নেসার আহমেদ! মদে চুর। একটি যুবতী মেয়ের কোমরে হাত দিয়ে টলতে টলতে ঢুকলো। পেছনে কোরবান।
মি. সিম্পসনের চোখ দুটি মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠলো।
ব্রাদার সিম্পসন!
মদে চুর নেসার আহমেদ উদারতায় বিগলিত। তোমার প্রতি যে নির্দয় ব্যবহার আমরা করছি তার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত। কি বলো কোরবান?
কোরবান আলী সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানায়।
সুতরাং আমরা ঠিক করেছি বেশিদিন তোমরা আমাকে, কি বলে, আমরা তোমাকে এভাবে কষ্ট দেব না। হাঁ কষ্ট দেবো না।
নেসার আহমেদ মমতায় বিগলিত হয়ে যুবতী মেয়েটিকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে আরো কাছে আকর্ষণ করলো। অত্যন্ত চটুল দেখতে মেয়েটা প্রথমে ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। পরে নেসার আহমেদের নির্দয় আলিঙ্গনের ভেতর খসখসে চাপা গলায় হেসে উঠলো।
তুমি এখন পাশের ঘরে যাও চম্পা। নেসার আহমেদ: আলিঙ্গন থেকে মেয়েটিকে মুক্ত করে দিয়ে বিড়বিড় করলো। বললো, আমি এখন ব্রাদার সিম্পসনের সঙ্গে কথা বলবা।
চম্পা নামধারী মেয়েটা চলে গেল।
নাউ ব্রাদার সিম্পসন।
নেসার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালো সিম্পসনের। বললো, আমি ঠিক করেছি তোমাকে আর দুদিন বাদে মুক্তি দেবো।
মি. সিম্পসন এই কথার অর্থ ভালো করেই জানেন। তিনি শুধু বললেন, তুমি যাই করো নেসার, আমি তোমাকে ঘৃণা করি।
নেসার হো হো করে হেসে উঠলো। বললো, তুমি লোকটা বেশ বুদ্ধিমান সিম্পসন। তবে ঐদিন আমাকে ধরতে গিয়ে যে বোকামী করেছে তার তুলনা হয় না। তোমার গাধামি আর বুদ্ধি দেখে আমি চমৎকৃত হয়েছি। আমি ঠিক করেছি যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।
মি. সিম্পসন শুধু তাকিয়ে রইলেন। নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো। বললো, মর্যাদার সঙ্গে কেন বললাম জানো? সাধারণ মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে তোমারটা তফাৎ থাকবে। তোমাকে প্রথম ছেড়ে দেয়া হবে আমার শিকারী কুকুরগুলোর ভেতর। কুকুরগুলোকে ট্রেনিং দেয়া আছে। ইশারা করলেই তারা তোমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তোমার পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হবে। হাতের বাঁধন অবশ্য ঠিকই থাকবে। তবে তোমার কোনো অমর্যাদা হবে না। আমি কথা দিচ্ছি শিকারী কুকুরগুলো তোমাকে টেনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবার আগেই তোমাকে সরিয়ে ফেলা হবে। এরপর তোমাকে এক জালা লবণাক্ত গরম পানির ভেতর রাখা হবে। তারপর …
নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো। বললো, খুবই দুঃখের বিষয় যে, তোমার মুক্তি দুদিন পিছিয়ে দিতে হবে। এর কারণ কি জানো? কারণ হচ্ছে আমার প্রভুভক্ত শিষ্য কোরবান আলীর প্রার্থনা। দুদিন পর আমার জন্মদিন। কোরবান আলী প্রার্থনা জানিয়েছে ঐদিন যেন তোমাকে মুক্তি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
একটা ঢেকুর উঠলো নেসার আহমেদের। পাশ ফিরে হাঁটতে হাঁটতে বললো, সিম্পসন সাহেব, আমার এখানকার কাজ প্রায় শেষ। আর সপ্তাহ খানেকের ভেতর আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। দুঃখ রইলো দেশে ফিরে গিয়ে তোমার মতো বন্ধুর দেখা পাবো না। হাঃ হাঃ।
সিম্পসন সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, তোমারও দিন ফুরিয়েছে!
কোরবান আলী উত্তেজিত হয়ে চাবুকে হাত দিলো। তার একটা মাত্র চোখ ধিকি ধিকি আগুনে জ্বলছে। নেসার আহমেদ তাকে বাধা দিলো। বললো, যেতে দাও কোরবান। সাহেব গোসা হয়েছেন। কিন্তু সাহেব, এই কথাটা বুঝলেন না যে তিনি আমাদের ধরতে পারলে আমাদেরও সোজা শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন!
নেসার আহমেদ হাসতে লাগলো।
*
দীবা হাতের রিস্টওয়াচ দেখলো। কুয়াশা গেছে আড়াই ঘন্টারও ওপর। আর অপেক্ষা করা ঠিক না। সে গোগীর দিকে তাকিয়ে তার মনোভাব জানার চেষ্টা করলো। গোগী উঁচু একটা পাথরের উপর গম্ভীর হয়ে বসেছে। ভাঁটার মতো চোখ জোড়া নিরতিশয় চিন্তিত।
দীবা ডাকলো। গোগী।
গোগী অভ্যাস বশে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার বসে পড়লো। ভাবখানা, তুমি ডাকাডাকি করছো কেন? আমি তোমার চাকর? এই আমি বসলাম। সাহেব না আসা পর্যন্ত উঠবো না। যা খুশি মনে করতে পারো।
দীবা আবার ডাকলো, গোগী।
এইবারও প্রথমটায় গোগী চঞ্চল হয়ে উঠলো। দীবার ডাকের ভেতর আদেশের সুর ছিলো। সেই সঙ্গে ছিলো স্নেহ ও আদরের স্পর্শ। সে আদেশ প্রতিপালন করার জন্যে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হলো সেই গম্ভীর, সমোহনকারী আদেশ তো এ নয়। গোগী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
দীবা হাত দিয়ে পথ দেখিয়ে দিলো। ইঙ্গিত করলো। একটু ইতস্ততঃ কর গোগী দীবার বশ মানলো। সে দেখেছে সাহেব দীবার বন্ধু তোক। তার সঙ্গে কথা বলার সময় সাহেব কখনো গুলি ছোঁড়াছুড়ি করেন না। কখনো রাগ হয়ে হাত পা ছোঁড়েন না। বরং হাসি মুখে কথা বলেন। গোগী ইঙ্গিত পেয়ে এগিয়ে গেল।