কুয়াশা এখনো পরিশ্রম ও সাধনার ফল পায়নি।
সে এগোলো। এক মুহূর্ত বুঝি কি ভাবলো। ডেকে আনবে নাকি দীবাকে, জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহকে? দীবা দাঁড়িয়ে আছে সপ্তম দেয়ালের বাইরে। চকিতে আর একটা কথা ভাবলো কুয়াশা। তীক্ষ্ণ বাণের মতো কথাটা বিদ্ধ হয়ে আছে এতক্ষণ। না , দীবাকে সে সন্দেহ করে না। সে ভাবছে নক্সাটার কথা। যে নক্সা তার অধিকারে আছে, যে নক্সার নির্দেশানুযায়ী এতদিন কাজ করেছে, কই সে নক্সার পথ ধরে ঈপ্সিত এই শয়ন মন্দিরে আসার পথ তো সে পায়নি। দুর্ঘটনা কিংবা আকস্মিকতা তাকে এই গুপ্ত পথটির সন্ধান দিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়েছিল বলেই এখানে আসতে পেরেছে। ৩ গ্য তার প্রতি সদয় বলেই এই শয়ন মন্দিরের গুপ্ত কক্ষে সে পদার্পণ করতে পেরেছে। কিন্তু যদি আকস্মিক এই ঘটনা না ঘটতো?
দাঁতে দাঁত ঘষলো কুয়াশা। তার কপালে ঘামের চিহ্ন ফুটে উঠলো। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো। নেসার আহমেদ, তুমি যতো বড় ধুরন্ধরই হও না কেন–আমার হতে তোমার রক্ষা নাই। ফিস ফিস করে কুয়াশা যেন নিজের সঙ্গেই কথা বললো। তার নিজের নক্সাটা ভূল, আর তার প্রতিপক্ষ নেসার আহমেদ ঠিক নক্সা ধরে ঠিক পথে এগিয়ে এসেছে ভাবতে গিয়ে কুয়াশা ঘৃণায়, ক্রোধে আর হিংসায় ভেতরে ভেতরে আচ্ছন্ন, উন্মত্ত হয়ে উঠলো।
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো শয়ন মন্দিরের দিকে। না দীবাকে সে ডাকবে না। এখনকার প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। গুরুত্বপূর্ণ। নেসার আহমেদ ও তার দলবল সন্ধান জেনেছে এই গুহার, এই ধন-রাজির। একটু ভুল করলে রক্ষা নেই। রাজা আখতানের পিতামহের সঙ্গে মৃত্যুর রাজত্বে কাটাতে হবে তাকে।
সে হাসলো। তার অস্তিত্বের চারদিকে হাজার হাজার বছরের স্মৃতি। আচ্ছন্ন। অলো। আলো। প্রেতাত্মা ও নেসার আহমেদের জিঘাংসার ভ্রূকুটি।
এবারে আর ভুল করলো না কুয়াশা। পিরামিড-তত্ত্ব সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। সে প্রতিটি পাথরের ইতিহাস বলতে পারে। প্রতিটি স্তম্ভের নির্মাণ রহস্য জানে। ফেরাউনদের শক্তিমত্ত মনটির পরিচয় তার কাছে পরিস্ফুট। প্রথমে সে শন মন্দিরের দিক নির্ণয় করলো দিকদর্শন যন্ত্রটি দিয়ে। চিরকাল মিশরের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য নীল নদ। নীল-নদ এই দেশের পবিত্র মাতৃ জঠর। আবহমান কাল থেকে নীল-নদের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ দিগন্ত মিশরবাসীদের কাছে পূজ্য। শয়ন মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্ত বেছে নিলে৷ কুয়াশা। দক্ষিণ প্রান্তের দেয়ালের বিশেষত্ব সহজেই চোখে পড়ে। অনেক কটা বিচিত্র পাথর একত্রিত করে সেই দেয়াল নির্মিত। এক একটি পাথরের এক এক রকম রঙ। দে!লের মাঝখানে একটি প্রশস্ত ও মসৃণ মেজেন্টা রঙের পাথর। একটার পর একটা পাথর পরীক্ষা করলো কুয়াশা। মেজেন্টা রঙের পাথরে হাত দিতেই পাথরটি বড়ির পেণ্ডুলামের মতো দুলতে লাগলো। কিন্তু খুব ধীর গতিতে। একটু একটু পাথরটি সরতে লাগলো। ভেতর থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি গুহা মুখ। পাথরটি স্থানচ্যুত করার অনুরূপ ব্যবস্থা দেয়ালের ভেতর দিকেও রয়েছে। কুয়াশা পাথরটির গতির ভারসাম্য রক্ষা করে দেয়ালের ভেতর দিয়ে গুহা মুখে পৌঁছলো। গুহা ধরে নেমে গেল নিচে।
নিচে নেমেই ভয়ে, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলো কুয়াশা। সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে রাজা এ্যামন হোটাপ। স্থির, অবিচল, নিষ্ঠুর মূর্তি।
.
০৮.
মি. সিম্পসন বন্দী অবস্থায় নেসার আহমেদের দুই নম্বর আড্ডায় দিন কাটাচ্ছিলেন। নেসার আহমেদের দুই নম্বর আড্ডা মরুভূমির নিচে, একটা শিলাময় পাথুরে গুহার ভেতর। তাঁকে রাখা হয়েছিল ছোটো একটা ঘরে। কোরবান আলীর হুকুম ছিলো তাকে সর্বদাই হাত পা বেঁধে রাখার। তিন দিনের ভেতর এক মুহূর্তের জন্যে এই হুকুমের এদিক ওদিক হয়নি। মি. সিম্পসন বন্দী হওয়াতে যতো না বিমর্ষ হয়েছিলেন, অপমানের জ্বালায় তার চেয়ে বেশি হয়েছিলেন যন্ত্রণাহত। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত স্বনামধন্য গোয়েন্দা সিম্পসন মৃত্যুকে ভয় পায় না। কিন্তু চালের সামান্য একটা ভুলে তাকে বন্দী হতে হলো, আর বন্দী হয়ে এমন অসহায় অপমানকর জীবন যাপন করতে হচ্ছে-এই যন্ত্রণা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক আর গ্লানিকর। মি. সিম্পসনের চেহারায় এই কদিন বিপুল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তাঁর প্রশস্ত ললাটে অসংখ্য বলি রেখা ফুটে উঠেছে। চোখ দুটি উন্মাদের মতো সর্বদা জ্বলছে। হাত পা শৃঙ্খলাবদ্ধ। সিম্পসন সর্বক্ষণ একটা কোনো উপায় খুঁজছেন এই বন্দীশালা থেকে মুক্ত হবার। একটা কোনো সূত্র খুঁজছেন জেবা ফারাহর হত্যাকারী নেসার আহমেদকে সমুচিত শিক্ষা দানের। কিন্তু, তার সব চেষ্টা নিষ্ফল। সব চিন্তা অসহায়।
মি. সিম্পসন নিষ্ফল আক্রোশে গুহার আবছা অন্ধকার ও অসহায় বন্দীত্ব সহ্য করেন। তাঁর ঘরের সামনে রাখা হয়েছে কোরবান আলীর জনৈক বিশ্বস্ত চেলাকে। সে প্রতিক্ষণ সজাগ হয়ে প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে থাকে। দুএকবার মি. সিম্পসন, আকারে ইঙ্গিতে তাকে প্রলোভন দেখিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রহরীটা শুধু হেসেছে আর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি মেলে তাকিয়েছে মি. সিম্পসনের দিকে। মি. সিম্পসন বলছেন, তুমি তাকিয়ে কি দেখছো?
আপনাকে দেখছি। আপনি বাঁচতে চান, না?
আমি নেসার আহমেদকে ধরতে চাই। সে একটা খুনে ডাকাত। তুমি আমাকে সাহায্য করা। আমার সরকার তোমাকে অনেক টাকা দেবেন।