দীবা মানা শুনলো না। উন্মাদিনীর মতো সে ছুটতে লাগলো।. পিরামিডের রহস্য উদ্ধারের নেশা বড় ভয়ানক। গুপ্তধনের লোভ বড় প্রচণ্ড। সেই লোভে পড়ে প্রাণ দিয়েছে হতভাগিনী জেবা। পিরামিডের অতল রহস্যের হাতছানি হয়তো দীবাকেও টানছে।
দীবা, শোনো।
কুয়াশা প্রাণপণে চিৎকার করলো। অন্ধকার গুহায় সেই শব্দ প্রতিধ্বনির পর প্রতিধ্বনি ঢেউ তুলে সর্বত্র গমগম করতে লাগলো।
কুয়াশা ছুটছে। আর এক মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপরই দীবাকে সে ধরতে পারবে।
হঠাৎ প্রবল শব্দে বসে পড়লো একটি প্রকাও পাথর। দীবা আর্তনাদ করে উঠলো। ততক্ষণে সে কুয়াশার বাহুবন্ধনে। এক চুল এদিক ওদিক হলে প্রকাণ্ড সেই পাথরটি তার উপর এসে পড়তো। তারপর কি হতে ভাবতে গিয়ে চোখ বুজলো দীবা। প্রাণপণে সে আঁকড়ে ধরলো কুয়াশার গলা। তার বুকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে লাগলো।
কুয়াশা দীবার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। কিন্তু সম্মুখের দিকে তাকিয়ে তার সমগ্র সত্তা স্থির হয়ে গেল। পথটা চলে গেছে দক্ষিণে। এই পথটি সপ্তম প্রাচার অতিক্রম করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে কি নক্সা বর্ণিত সপ্তম প্রাচীর শেষ স্থান: নয়? কিন্তু তাই বা কি করে হয়?
অনেকক্ষণ পর দীবা সংবিৎ ফিরে পেলো। আস্তে আস্তে সে কুয়াশার বাহু-বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সে বুঝলো তার আতঙ্কের কারণ ছিলো যা সেই শব্দটা আর কোথাও নেই। কিন্তু স্বলিত সেই পাথরের ওপাশ দিয়ে একটি গুহা মুখ বেরিয়ে পড়েছে। যেন মুখব্যাদান করে প্রচণ্ড এক মৃত্যু তাদের আহ্বান জানাচ্ছে। সে দেখলো। তার মতো কুয়াশীও নির্বাক দৃষ্টিতে সেই নতুন পথটির দিকে তাকিয়ে আছে।
এই হচ্ছে সঠিক পথ…
দীবা ফিসফিস করে বললো, এই পথ ধরে গেলে আখতানুনের ধন-রত্নের সন্ধান পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি ধনরত্ন চাই না। আমি বাঁচতে চাই। আমি জানি, যে ঐ পথে একবার ঢুকেছে, সে আর কখনো পৃথিবীতে ফিরে যায়নি। কখনো যায়নি…
স্থির হও, দীবা…
কুয়াশা যেন তিরস্কার করলো। বললো, ভেবে দেখো তুমি ইচ্ছে করেই এখানে এসেছে। তুমি ভয় পাবে জেনেই তোমাকে আনতে চাইনি। কিন্তু যখন এসেই পড়েছে, দয়া করে গোলমাল করো না। আমি না আসা পর্যন্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। গোগী…
গোগী কাছে এসে দাঁড়ালো। বুঝলো তার প্রভু বলছেন এই দুর্বল মানুষটিকে তোর জিম্মায় রেখে গেলাম রে গোগী। কেউ যেন ওর অনিষ্ট করে দেখিস বাবা!
সে ভারি খুশি হয়ে দীর দিকে তাকালো। ক্রমাগত মাথা নাড়তে লাগলো। প্রভু এই মানুষটিকে বিশ্বাস করেন, পছন্দ করেন সুতরাং এ নিশ্চয়ই শত্রু নয়, বন্ধু। গোগীর ভয়াল হাসিতে যেন কৃতজ্ঞতা ও স্নেহ ঝরতে লাগলো।
দীবাকে পেছনে রেখে কুয়াশা স্থির অবিচল ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল! কেন যেন তার মনে হচ্ছিলো এই পথে কারো কারো যাতায়াত হয়েছে। তার এই ধারণা বদ্ধমূল হলো কিছুদূর এগোতেই। দেখলো একটি কম্পমান ছায়া পথের শেষ প্রান্তে টর্চের আলো ফেলে এদিকে আসছে।
মুহূর্তে কুয়াশা থামের আড়ালে আত্মগোপন করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলো। সেই কম্পমান ছায়া ক্রমে আরো কাছে এগিয়ে এলো। একেবারে কুয়াশার কাছাকাছি, তিন হাতের ভেতর। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কুয়াশা চিনলো লোকটিকে। নেসার আহমেদ। চিরকালের এই ভয়ঙ্কর শত্রুকে চিনতে আর ভুল হবার কথা নয়। উত্তেজিত হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হচ্ছিলো আর দেরি না করে এই মুহূর্তে জীবনের চরম শত্ৰু এই নেসার আহমেদকে রিভলভারের একটি গুলিতে শেষ করে দেয়। বহু কষ্টে সে উত্তেজনা দমন করলো। এখনো নেসারের সঙ্গে বোঝাপড়া করার সময় আসেনি। সময় আসুক নেসার আহমেদের মুখোমুখি সে নিশ্চয় হবে। দম বন্ধ করে নেসার আহমেদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলো সে।
নেসার আহমেদ থমকে দড়িয়েছে। কি ভেবে সে চারপাশে তাকাতে লাগলো। সম্ভবতঃ সে ধরে নিলো কেউ কোথাও নেই। তাকে নিশ্চিন্ত মনে হলো। দেয়ালের গায়ে একটা পাথরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দেখতে দেখতে দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল। দেখা দিলো একটা আবছা সিঁড়ি পথ। সেই সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল নেসার। মুহূর্তে বন্ধ। হয়ে গেল দেয়ালের ফাঁকটুকু।
অনেকক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সম্মুখে। সঙ্কীর্ণ পথের বাঁক ঘুরতেই অপূর্ব এক সুরম্য মন্দির চোখে পড়লো। ক্ষুদ্রকায় এই মন্দিরটির সামনে প্রশস্ত অঙ্গন। মন্দিরের চূড়ায় চূড়ায় অলিন্দে অলিন্দে দামি পাথরের কারুকার্য। বড় বড় থাম। কুয়াশা বুঝলো এটিই সমাধি মন্দির। উত্তেজনা তার সর্ব সত্তা জ্বলছিল। সে মন্দিরের ভেতর ঢুকলো।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কুয়াশা। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। দেখলো শয়ন মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে, চূড়ায়, উঠোনের মর্মর মূর্তিতে বসানো রয়েছে ঝলকিত হীরা-মুক্তা-মাণিক্য। বড় বড় হীরা মুক্তা মাণিক্যের পাথর থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে দ্যুতি। সেই দুতির আলোয় শয়ন মন্দিরের সময় প্রাঙ্গণ আলোকিত। আলোকিত হয়তো নয়। এক রকম লাল-নীল-সবুজ আলোর কোমলতায় চতুর্দিক আচ্ছন্ন।
কুয়াশা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো জানে না। তার হাতের কাছেই কুবেরের ঐশ্বর্য। রাজা আখতানুনের ধন-রত্নরাজি, যা নাকি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল জ্ঞানী চিকিৎসকের কাছে, যার জন্য জেবা ফারাহ্ প্রাণ দিয়েছে। না, এ সেই লুকায়িত ধন-রত্ন নয়। এইসব হীরা-মুক্তা-মাণিক্য শুধু সেই বিপুল ধন-রাজির একটা সামান্য আভাস মাত্র। শয়ন মন্দিরের মাটি খুঁড়তে হবে। কুড়ি ফুট মাটির নিচে রয়েছে সেই ঐশ্বর্য। আখতানুনের ঐশ্বর্য।