কুয়াশার বিস্ময়ের সীমা নেই। দেখলো সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছে আর কেউ নয়, দীবা।
সে তখনও হাঁপাচ্ছে। বললো, ম্যান-ট্রাপের ভেতরে পড়তে গিয়েছিলে তুমি। আমি জানতাম এমনি কিছু ঘটতে পারে।
কুয়াশা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো দীবার দিকে। গুপ্তধনের এই নক্সার সঙ্গে জেবা ফারাহর বোন দীবা ফারাহর সম্পর্ক থাকা অন্ততঃ অস্বাভাবিক নয়। কিংবদন্তী ও প্রবাদ সূত্রে দীবা পিরামিডের রহস্য সম্পর্কে হয়তো অনেক কথাই জেনেছে। কে জানে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে অযাচিত ভাবে কুয়াশাকে রক্ষা করার পেছনে পিরামিডের রহস্যের চাইতেও বড় ও জটিল রহস্য আছে কিনা।
প্রশ্ন করার প্রয়োজন ছিলো না! তবু কুয়াশা বললো, তুমি এলে কি করে?
বলছি…। দাবা হাঁপাতে হাঁপাতে বললো। পেছন দিকে তাকিয়ে হাসলো। বললো, তোমার ঐ গোগীর হাত থেকে আপাততঃ আমাকে বাঁচাও। সর্বক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর মুখ বেজার করে ভোঁ ভোঁস নিঃশ্বাস ছাড়ছে।
কুয়াশা হেসে ফেললো। বুঝলো, গোগীর ঈর্ষা হয়েছে। কুয়াশাকে কেউ পছন্দ করুক, কুয়াশা কাউকে পছন্দ করুক এ বোধহয় শ্রীমান গোগী চায় না। তার কাছে এসব খুব খারাপ লাগে। প্রথম প্রথম তো দীবাকে একদম সহ্য করতে পারতো না। কুয়াশা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে দেখলে হুঙ্কার ছাড়তো। কে জানে ছাড়া থাকলে হয়তো মেরেই বসতো দীবাকে। এখন ততটা আক্রোশ নেই। সে বুঝেছে তার প্রভু দীবাকে পছন্দ করেন। তাদের দুজনের ভেতর ভাব রয়েছে। দীবার ক্ষতি করলে তার প্রভু ব্যথা পাবেন, রাগ করবেন এটা জানার পর গোগী আর আগের মতো দীবার প্রতি প্রকাশ্যে হিংসা প্রদর্শন করে না। তবে দীবাকে দেখলেই সে ভয়ানক গম্ভীর হয়ে যায়। ভ্রূকুটির সঙ্গে দীর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ভেংচি মারতেও ছাড়ে না।
কোয়ায়েট গোগী…
কুয়াশা গোগীর দিকে তাকায়।
গোগী হাঁ করে তাকায়। ভাবটা, বাঃ, আমি আবার কি করলাম। পরে প্রভুর আদেশ বুঝতে পেরে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
কুয়াশার ডিটেক্টর যন্ত্রটি নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে। পাশে বসে সে ও দী। দীবার চোখ-মুখ উজ্জ্বল, আরক্তিম। মুজাদ্দিদ করীমের সঙ্গে আবার মিলিত হতে পারছে, হয়তো এই ভাবনায় সে সুখী। কুয়াশা মহুয়ার কথা মুহূর্তের জন্যে ভাবলো। মনে মনে হাসলো।
চলো এবার। কোথায়? কোথায় আবার, লঞ্চে।
কুয়াশা প্রথমেই জবাব দিলো না। সে দীবার সুন্দর মুখখানি দেখতে লাগলো। দীবা আবার বললো, কি হলো…
তুমি যাও দীবা। আমি যাবো না।
কেন?
যে কাজের জন্য বেরিয়ে এসেছি সে কাজ উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমার বিশ্রামের প্রশ্ন ওঠে না। তুমি বরং যাও।
দীবা প্রতিবাদ করলো না। কিছুদিনের ভেতর এই লোকটির স্বভাব সে জেনে ফেলেছে। চারদিকে সে তাকালো। আবছা আবছা অন্ধকার। ভ্যাপসা গরম। সামনে সপ্তম প্রাচীরের ছায়া ছায়া অলিন্দ দেখা যায়। সঙ্কীর্ণ পথের এখানে ওখানে কি ভাবে মৃত্যু ওঁৎ পেতে আছে কে জানে?
ওরা এগোলো। কুয়াশা একটা গভীর গর্তের মুখে পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। পিরামিডের নানা স্থানে এইসব গভীর গর্ত লুকিয়ে আছে। কতো অসংখ্য লোক এই ধরনের গর্তে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়াত্তা নেই।
কিছুদূর এগিয়ে সামনে পড়লো একটি ভগ্ন দেয়াল। দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে বিরাটকায় এক বিড়ালের মূর্তি। ফারাহদের যুগে মিশরের লোকেরা বিড়াল পূজা করতো। তাদের কাছে বিড়াল ভাগ্যদেবী। সাধারণতঃ পিরামিড এইসব বিড়ালের মূর্তি রাখা হয় মৃত রাজা বা রাণীর শিয়রের কাছাকাছি একটা স্থানে। বিড়ালের মূর্তি : দেখে কুয়াশা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বললো, আমরা তাহলে সমাধি মন্দিরের কাছে এসে পৌঁছেছি।
দীবা জবাব দিলো না। কুয়াশার সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকেই একটা সন্দেহ তার মনে দেখা দিয়েছিল। বলি বলি করেও সেই সন্দেহের কথা কুয়াশাকে সে খুলে বলেনি। বিড়ালের মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছিলো কুয়াশা কোথাও ভুল করেছে।
ঠিক এই সময় একটা হাতুড়ি-ঠোকার ক্ষীণ শব্দ দেয়ালে দেয়ালে ঘা খেয়ে ভেসে এলো। চমকে উঠলো দুজনেই। কুয়াশা কান পাতলো। তার চোখ দুটি বিস্ময়ে ঝিকিমিকিতে ভরে গেল। শব্দটা ক্রমে স্পষ্ট ও স্থায়ী হলো। মনে হলো কাছেই কোথাও শব্দটা বেজে চলেছে।
গোগী তখন ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠেছে। শব্দটা তারও কানে এসেছে। তার ভাষায় এই শব্দের অর্থ যুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বীকে আহ্বান। টুক টুক টুক ঠাক। শব্দটা মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। আবার জেগে ওঠে। গোগী দুই হাতে বুক চাপড়াতে লাগলো। তার চোখ মুখ অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় কঠোর ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।
কুয়াশা বললো, গোগী!
গোগী বুঝলো তার প্রভু বলছেন এ তোমার শত্রু নয়, চোগী। তুমি শান্ত হও।
সে হাঁ করে প্রভুর দিকে তাকালো। তারপর দীর দিকে। শান্ত হয়ে গেল।
নিশ্চল, নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল কুয়াশা। তাকে পেছনে রেখে হঠাৎ এগিয়ে গেল দীবা। যেন ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইলো। কুয়াশা প্রথমে বিস্মিত হলো। তারপর বুঝলে পিরামিডের গোলক ধাঁধার রহস্যে অস্থির হয়ে উঠেছে দীবা। হয়তো সে এই অন্ধকার গুহা থেকে বেরিয়ে মুক্ত আলোর দেশে যেতে চায়। হু হু হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস নিতে চায়।
সে-ও ছুটতে ছুটতে দীবাকে অনুসরণ করলো। ডাকলো, দীবা, দীবা..