আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে কুয়াশা নিঃসন্দেহ হলো। না, কেউ নেই। এই অন্ধকার মাইকেরিনোস পিরামিডে কারো থাকার কথাও নয়। এই পিরামিডে অতীতে কার পদচিহ্ন পড়েছে কুয়াশা জানে না। হয়তো পদচিহ্ন পড়েছে, ফারাওদের, তাঁদের অনুচরবর্গের ভাস্কর বা প্রত্নতত্ত্ববিদের। কিন্তু এই বিষয়ে কুয়াশা নিশ্চিত যে এই দুই মাসের ভেতর এই পিরামিডের অভ্যন্তরে গোগী ছাড়া তৃতীয় কোনো প্রাণীর আবির্ভাব ঘটেনি। দৃষ্টিবিভ্রম নিশ্চয়ই। কুয়াশা আর কালক্ষেপ না করে সোজা দেয়ালের অন্ধকার পথে নেমে গেল। এটি তৃতীয় প্রাচীরের শেষ সীমান্ত। আর চারটি প্রাচীর অতিক্রম করলেই ফারাওদের মূল সমাধি মন্দির পাওয়া যাবে। নক্সার নির্দেশ মতে সমাধিস্থ ফারাওর শিয়রের দশ হাত মাটির নিচে আখতানের সেই ধন-রত্ন প্রোথিত।
সম্মোহিতের ন্যায় এগিয়ে চললো কুয়াশী। বিশেষ ভাবে তৈরি ইলেকট্রিক টর্চ লাইটের আলায় হাজার হাজার বছরের জমাট বাঁধা অন্ধকার এক একবার যেন চমকে উঠছে। এতক্ষণে তার হাতে রাখা ডিটেক্টর যন্ত্রটি সে চালু করেছে। এই যন্ত্রটি সে পিরামিডের রহস্য উদ্ধার করার জন্যে উদ্ভাবন করেছে। সেই সুদূর পঞ্চদশ শতক থেকে
শুরু করে এই পর্যন্ত প্রতিটি প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণা কুয়াশার নখদর্পণে। সে জানে। ১৮৩৭ সালে বৃটেনের প্রত্নতাত্ত্বিক গোষ্ঠি চিপস পিরামিডের রহস্য ও গোপন কক্ষ সমূহ আবিষ্কারের চেষ্টা করে কতকটা সফলতা লাভ করেছিলেন। তাঁরা পিরামিডের অভ্যন্তর ভাগে প্রবেশ করেন। যেখানেই তাঁরা দ্বার রুদ্ধ দেখেছেন সেখানেই তাঁরা গোলা বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পথ তৈরি করেছেন। কিন্তু এভাবে পিরামিডে প্রবেশের পথ করা যায়, পিরামিডের রহস্য উদ্ধার অসম্ভব। অনেক গবেষণার পর কুয়াশা এই ডিটেক্টর যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছে। এই যন্ত্রটির সাহায্যে তীব্র শক্তিশালী মহাজাগতিক রশ্মি পিরামিডের দেয়ালে প্রেরণ করা যায়। এই মহাজাগতিক রশি রঞ্জন রশ্মি অপেক্ষাও শক্তিশালী। এই রশ্মি ৩০০০ মিটারেরও বেশি ঘনত্ব ভেদ করে চলে যেতে পারে। এই রশ্মি পাঠিয়ে কুয়াশা ষষ্ঠ প্রাচীর পর্যন্ত মাইকেরেনোস পিরামিডের অভ্যন্তরস্থ সব রহস্য অবগত হয়েছে। বাকি আছে সপ্তম ও শেষ প্রাচীর। কিছুক্ষণের মধ্যে সব রহস্য কুয়াশার জ্ঞাত হবে।
অন্ধকার প্রাচীর পথের একস্থানে এসে কুয়াশাকে থামতে হলো। টর্চ লাইটের আলো ফেলে দেখলো, সামনের পথ রুদ্ধ। নতুন একটি দেয়াল উঠেছে। তবে কি এটিই সপ্তম দেয়াল? কুয়াশা উগ্র চিত্রে নক্সার নির্দেশ অনুযায়ী বাঁ দিকে দশ পদক্ষেপ এগিয়ে গেল। একটি পাথরের স্তম্ভের উপর ভীষণকায় এক সাপের মূর্তি। মনে হয় যেন ফণা দোলাচ্ছে। কিন্তু আসলে এটি আর কিছু নয়, পাথরের গড়া মূর্তি। সাপের চোখে টিপ দিতেই একটি গুহা মুখের মতো দরজা খুলে গেল। কিন্তু ভেতরে এক পা দিতেই প্রচণ্ড এক আর্তনাদ করে কুয়াশাকে পিছিয়ে আসতে হলো।
.
০৬.
কায়রোর বিখ্যাত কসমোপলিটান হোটেলের লনে এক বৃদ্ধ ইহুদী অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন তাঁর মাথার চুল সাদা। নাকে ফ্রেম হীন চশমা। তীক্ষ্ণ নাকের ওপর দুটি ঘোলাটে চোখ। ভদ্রলোক ঘড়ি দেখছিলেন আর দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর আর একজন বৃদ্ধ ইহুদী কাঁধে ট্যুরিষ্ট ব্যাগ ঝুলিয়ে আস্তে পায়ে লনে ঢুকলেন। প্রথমোক্ত ইহুদী সচকিত হয়ে তাকালেন।
হ্যালো জন।
জন এগিয়ে এসে এক গাল হাসলো। ইংরেজিতে বললো, ঘন্টা খানেকের ভেতর না গেলে কিন্তু…
আমার সব ব্যবস্থা ঠিক আছে। তুমি বরং এক কাজ করে। এই ফোন নাম্বার নিয়ে সুপার সাহেবকে জানিয়ে দাও
রাইট স্যার।
আমি রিসেপশনের দিকে যাচ্ছি। বিলটা মিটিয়ে সোজা ছুটবো।
তখন অনুমান সকাল নটা। আরবী পোশাকে সজ্জিত একদল সামুদ্রিক জাহাজী ডাম বাজিয়ে হল্লা করতে করতে যাচ্ছিলো।
রাস্তার লোকজন অবাক হয়ে ওদের দেখছিল। কিন্তু সেদিকে ওদের দৃকপাত নেই। বণিক দলটি দুইদিন আগে সুমাত্রা থেকে জাহাজ বোঝাই নানাপ্রকার মসলা ও ফলল নিয়ে কায়রো ফিরেছে। সমুদ্রে ভেসে ভেসে ওরা জীবন কাটায়। ওদের জীবনের ভরসা কি? বাধা বিপদের মুখে যে কোনো সময় ওরা আক্রান্ত হতে পারে। মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই সুযোগ পেলেই আমোদ প্রমোদে এরা সময় কাটায়। দলটি দুইদিন হলো এসেছে। এসে নানা ভাগে ভাগ হয়ে নগরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। আলোচ্য দলটি কসমোপলিটান হোটেল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে চলেছে। কায়রোর দক্ষিণ প্রান্তে গানের জলসা বসে রোজ দুপুরে। উন্মুক্ত ময়দানে খেজুর গাছের ছায়ার নিচে যাযাবর রমণীরা মিশরীয় বেদুইনের হাতের ম্যাণ্ডোলিনের বাজনার তালে তালে নৃত্য করে। যাযাবর রমণীদের চোখের কটাক্ষ মদির। লাল ঘাগড়ার ঢেউয়ে আরব সাগরের বাতাস নাচে।
ড্রাম বাজিয়ে বাজিয়ে ওরা চলেছে। হঠাৎ এক অভিজাত অট্টালিকার কাছে এসে দলটি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো। ওরা কেউ লক্ষ্য করলো না অট্টালিকার দ্বিতল জানালায় বাইনোকুলার চোখে যে লোকটি দাঁড়িয়েছিল সে হঠাৎ উচ্চকণ্ঠ হেসে উঠলো।
লোকটি যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। পরনে দামি পোশাক। চোখে গগলস আঁটা। সে হঠাৎ হাসতে শুরু করলো। হাসি আর থামতে চায় না। দরজা দিয়ে তড়িৎ পায়ে ছুটে এলো দীর্ঘকায়, কুৎসিত একটি লোক। অস্থির গলায় বললো, ওস্তাদ ওরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে।