বেটা বেয়াদব কুকুর! মাস্টারকে থামিয়ে দিয়ে গর্জে উঠলেন ব্লাই। সামান্য কোন অভিযোগও যদি পাই, আবার.আমি ধরব বদমাশটাকে। পরের বার দুই নয়, চার ডজন লাগাব।
ক্যাপ্টেন থামতেই ক্রিশ্চিয়ান বলল, আমার মত যদি চান, তাহলে বলব, দুর্ব্যবহারের চেয়ে সদয় ব্যবহার করেই বারকিটের মত মানুষদের পোষ মানানো সহজ…।
ওকে শেষ করতে না দিয়ে ব্লাই হেসে উঠলেন হা-হা করে। মিস্টার ক্রিশ্চিয়ান, মেয়েদের স্কুলে মাস্টারি নিলেই ভাল করতে তুমি! হা-হা, সদয় ব্যবহার, তাই না? গ্লাস তুলে চুমুক দিলেন তিনি। এসব উদ্ভট চিন্তা মাথা থেকে নামাও, ভাল ক্যাপ্টেন হতে পারবে তুমি। সদয় ব্যবহার, হা! আমাদের নাবিকরা গ্রীক যতটুকু বোঝে সদয় ব্যবহারের মর্যাদা ঠিক ততটুকু বোঝে। ওরা যা ভাল বোঝে, তা হলো শাসন, কড়া শাসন! না হলে বিদ্রোহ আর দস্যুতা সাগরের নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াত।
তা অবশ্য ঠিক, স্বীকার করল ফ্রায়ার। কিন্তু মাথা নাড়ল ক্রিশ্চিয়ান। আমি মানতে পারছি না কথাটা, বিনয়ের সাথে সে বলল। আর দশজন ইংরেজের সাথে কোন পার্থক্য নেই আমাদের . নাবিকদের। কিছু কিছু লোক আছে সত্যিই যাদের কড়া শাসনে রাখতে হয়, তবে ভাল লোকও আছে যারা দয়ামায়াওয়ালা যোগ্য নেতার নেতৃত্বে নির্ভয়ে মৃত্যুর মুখে পর্যন্ত যেতে দ্বিধা করবে না।
তেমন কোন লোক আছে আমাদের জাহাজে? নাক সিটকানো ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন ব্লাই।
আমার মনে হয় আছে, স্যার, আগের মতই বিনীত কণ্ঠে বলল ক্রিশ্চিয়ান, এবং সংখ্যায় তারা খুব কম নয়।
সত্যিই! একজনের নাম করো তো!
ছুতোর মিস্ত্রী মিস্টার পার্সেল। লোকটা…
এবার আগের চেয়ে অনেক উচ্চস্বরে, এবং বেশিক্ষণ ধরে হাসলেন ব্লাই। সত্যিই মানবচরিত্র বিচারে তোমার জুড়ি মেলা ভার, ক্রিশ্চিয়ান! ওই মাথামোটা বুড়ো বদমাশটা! হা-হা, সদয় ব্যবহার খুব ভাল বলেছ!
মুহূর্তে রক্ত উঠে এল ক্রিশ্চিয়ানের মুখে। অনেক কষ্টে রাগ সামলে সে বলল, বুঝলাম পার্সেলকে আপনার পছন্দ নয়। তাহলে মরিসন।
মরিসন! মানে সারেঙের মেট নেকড়ের চামড়া গায়ে ভেড়া? বলছ এদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে হবে?
নেকড়ের চামড়া গায়ে ভেড়া কি না জানি না, স্যার, বলল ফ্রায়ার, এটুকু জানি, ভাল নাবিক মরিসন। মিডশিপম্যান ছিল, তাছাড়া ওর নুও দ্র ঘরে।
জানা আছে আমার! ব্যঙ্গের সুরে বললেন ব্লাই। তোমরা যে যা-ই বলল আমার মত বদলাবে না। মরিসনকে সাবধান থাকতে বোলো! ওর দিকে নজর। রাখছি আমি। একটু বেচাল দেখলেই এমন শিক্ষা দেব..। কি বলছিলে?-দ্র ঘরের ছেলে? মানে চামড়াটা বারকিটের মত পুরু নয়? তাহলে তো আরও বেশি সাবধান থাকতে বলবে। ওর সারেঙও ওকে বাঁচাতে পারবে না।
খেতে খেতে আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করলাম ক্যাপ্টেন এবং মাস্টারকে। কিছুক্ষণের ভেতর কোন সন্দেহ রইল না ক্যাপ্টেনকে অপছন্দ করে ফ্রায়ার, পনির নিয়ে সেই ব্যাপারটা সে ভুলতে পারেনি। ব্লাইও অপছন্দ করেন তাঁর মাস্টারকে; সবচেয়ে বড় কথা, সেটা তিনি গোপন করার চেষ্টা করছেন না মোটেই। ক্রিশ্চিয়ানকেও তিনি পছন্দ করেন না, সেটাও লুকানোর চেষ্টা করছেন না। ভাবখানা তোমাদের আমি অপছন্দ করি এর ভেতর লুকোচুরির কি আছে?
কয়েকদিন পরে ওল্ড ব্যাকাস-এর কাছে শুনলাম, ক্যাপ্টেনের সাথে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে মাস্টার। অবাক হলাম না শুনে এমন কিছু ঘটবে, আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম।
.
বিষুবরেখা পার হয়ে এসেছে বাউন্টি।
টেনেরিফ থেকে প্রচুর কুমড়ো নিয়েছিলাম আমরা খাওয়ার জন্যে। বিষুবীয় অঞ্চলের উত্তাপে এবার সেগুলোয় পচন ধরল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন ব্লাই। রুটির বদলে নাবিকদের কুমড়ো সরবরাহের হুকুম দিলেন স্যামুয়েলকে; তাও দুপাউন্ড রুটির বদলে এক পাউন্ড কুমড়ো। স্বভাবতই ব্যাপারটা পছন্দ হলো না কারও। কুমড়ো নিতে অস্বীকার করল সবাই। যথারীতি স্যামুয়েল গিয়ে খবরটা জানাল ক্যাপ্টেনকে। সবাইকে ডেকে জড় হওয়ার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।
আমি দেখতে চাই, কার এত বড় সাহস যে কুমড়ো নিতে অস্বীকার করে! ক্রুদ্ধ বাঘের মত গর্জে উঠলেন তিনি। কুমড়ো তো ভাল জিনিস, আমি যা দেব তা-ই খেতে হবে, বদমাশের দল! যদি ঘাস দেই, তা-ও খেতে হবে।– কি করে তোমাদের শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি!
এবার আর কেউ অস্বীকার করল না কুমড়ো নিতে। তবে নিল ঠিকই কিন্তু বেশিরভাগই ফেলে দিল পানিতে।
দুএক দিনের ভেতরই আরেকটা গুঞ্জন উঠল, বিশেষ করে অফিসারদের ভেতর, মাংসের পিপেগুলোয় যে পরিমাণ মাংস থাকা উচিত আছে তার চেয়ে কম এবং এই কমটুকু পুষিয়ে নেয়ার জন্যে নাবিকদের সরবরাহ করার সময় কম দেয়া হয় ওজনে। অনেক দিন ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে কানাঘুষা চলছিল, এবার সরব হয়ে উঠল সবাই। তদন্ত করে ব্যাপাটার সুরাহা করার আবেদন জানাল, ওরা মাস্টারের কাছে। আবার সবাইকে ডেকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিলেন ব্লাই।
মিস্টার ফ্রায়ারের কাছে অভিযোগ করেছ, হ্যাঁ? চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন তিনি। খাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট নও তোমরা! শোনো শেষ বারের মত আমি বলছি, খোদার কসম বলছি, সন্তুষ্ট হওয়ার চেষ্টা করো। মিস্টার স্যামুয়েল যা করে আমার নির্দেশে করে; বুঝতে পেরেছ? হ্যাঁ, আমার নির্দেশে করে। অভিযোগ করে লাভ হবে না। কোন প্রতিকারই কেউ করতে পারবে না। কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক আমি জানি। তোমাদের অভিযোগ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি। আর না। এর পর আর কোন অভিযোগ যে করবে; কোন কথা। নেই, চাবকানো হবে তাকে। এ-ই আমার শেষ কথা। আশা করি মনে থাকবে সবার।