কয়েকদিন পরেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে আমরা যারা ব্লাইয়ের সমর্থকও নই আবার বিরোধীও নই-অর্থাৎ নিরপেক্ষ তারা বিরাট এক প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম।-সত্যিই কি এতখানি নীচ স্বভাবের মানুষ ব্লাই
সেদিন সকালে আবহাওয়া খুব ভাল। বাউন্টির প্রধান হ্যাঁচ তুলে রোদে দেয়ার জন্যে বের করে আনা হয়েছে আমাদের পনিরের মওজুদ। ঢাকনা খুলে দেয়া হয়েছে সবগুলো পিপের। ব্লাই নিজে তদারক করছেন কাজটা। হঠাৎ তার চোখ গেল একটা পিপের দিকে। পাউন্ড পঞ্চাশেক ওজনের দুটো পনির উধাও হয়ে গেছে তার ভেতর থেকে। দ্রুত পিপেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন ব্লাই। ঝুঁকে ভাল করে দেখলেন। তারপর আর্তনাদের মত তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল: ওহু, ঈশ্বর! চুরি গেছে।
কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল খালাসী হিব্রান্ড। সে বলল, না, স্যার, চুরি যাবে কেন?-আমরা যখন ডেপটফোর্ডে তখন এই পিপেটা খোলা হয়েছিল। আপনিই তো বলেছিলেন খুলতে। পনির দুটো, স্যার, তখন তীরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
চুপ! বদমাশ!
ক্রিশ্চিয়ান আর ফ্রায়ার ছিল কাছেই। তাদের দিকে একবার অগ্নিদৃষ্টি হেনে ব্লাই বলে চললেন, সব চোর। একেবারে দল ধরে। তোমরা সবাই ষড়যন্ত্র করছ আমার বিরুদ্ধে-অফিসার,নাবিক-সব। কিন্তু আমিও বলছি, সব কটাকে পোষ মানিয়ে তবে ছাড়ব, খোদার কসম বলছি। হিভ্রান্ডট-এর দিকে তাকালেন তিনি। আর একটা কথাও যদি শুনি তোর মুখে, চাবকে পিঠের চামড়া তুলে নেব, কথাটা মনে রাখিস। ঘুরে নিচে নামার সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন ব্লাই। তারপর আবার চিৎকার, মিস্টার স্যামুয়েল! এক্ষুণি ডেকে এসো!
দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে ডেকের ওপর উঠে এল স্যামুয়েল। বিগলিত ভঙ্গিতে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে।
পঞ্চাশ পাউন্ডের দুটো পনির চুরি গেছে, বললেন ব্লাই। একশো পাউন্ড পনির খেতে যতদিন লাগে ততদিন পনির দেয়া বন্ধ রাখবে-সাধারণ নাবিক, অফিসার সবাইকে!
স্পষ্ট দেখতে পেলাম অসন্তোষের ছাপ পড়ল ক্রিশ্চিয়ান এবং ফ্রায়ারের মুখে। কিন্তু কেউ কিছু বলল না। দুজনই বুঝতে পারছে এখন প্রতিবাদ করলে কি ফল হবে।
সেদিন থেকেই খাওয়ার সময় পনির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলো। তবে মাখন সরবরাহ চালু রাখা হলো। ফুল হলো মাখন নিতে অস্বীকার করল নাবিকরা। তাদের বক্তব্য পনির ছাড়া মাখন নেয়ার অর্থ চুরির অভিযোগ স্বীকার করে নেয়া। জন উইলিয়ামস নামের এক খালাসী তো ফোকাসল-এ সবার সামনে ঘোষণাই করে বসল, সে নিজে ছোট এক পিপে ভিনেগার এবং আরও কিছু টুকটাক জিনিস সহ পনির দুটো পৌঁছে দিয়ে এসেছিল মিস্টার ব্লাইয়ের বাড়িতে।
এরপর আমার মত নতুন যারা, যারা স্রেফ ক্যাপ্টেন কুকের সঙ্গী ছিল বলে দেবতার আসনে তুলে বসে আছে ব্লাইকে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে পাঠকরাই অনুমান করে নিন।
.
তিন
কয়েক দিন পর এক বিকেলে ব্লাই তার ভৃত্যকে পাঠিয়ে আমাকে খবর দিলেন যেন রাতে তার সাথে খাই।
সন্ধ্যার পর একটু বিশেষ সাজ সজ্জা করে গেলাম ক্যাপ্টেনের কেবিনে। দেখলাম ক্রিশ্চিয়ানকেও সঙ্গে খেতে বলেছেন ব্লাই। সাধারণত সাভন ওল্ড ব্যাকাস আর মাস্টার ফ্রায়ার ব্লাইয়ের সাথে এক মেসে খাওয়া দাওয়া করেন। আজ সার্জনকে অনুপস্থিত দেখলাম।, ক্যাপ্টেনের টেবিলে চমৎকার চমৎকার বাসন পেয়ালার প্রদর্শনী বসেছে যেন। কিন্তু ঢাকনাগুলো ওলটাতেই খেয়াল করলাম সাধারণ নাবিকদের চেয়ে মোটেই উন্নত নয় খাবারগুলো। নুন দেয়া গরুর মাংস-এটাই পরিমাণে সবচেয়ে বেশি, জঘন্য মাখন, আরও জঘন্য পনির-আমি নিজের চোখে ওগুলোর ভেতর থেকে লাল লাল পোকা বের করতে দেখেছি; খানিকটা নোনা বাঁধাকপি-স্কার্ভি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এটাই একমাত্র উপাদান আমাদের খাদ্য তালিকায়; আর বড় একটা বাসনে ঢিবি করা সেদ্ধ মটর কলাই ভর্তা, বাউন্টির নাবিকরা যার নাম দিয়েছে কুকুরের শরীর।
মদের গেলাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্লাই, যেন এমন সুস্বাদু খাবার জীবনে আর কখনও দেখেননি-খাওয়া দূরে থাক। এমন ভঙ্গিতে তিনি খেতে লাগলেন, দেখলে যে কারও মনে তাঁর ভদ্রতাবোধ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগবে। ফ্রায়ার লোকটা একটু রুক্ষ প্রকৃতির, সভ্যতা ভব্যতার ধার বড় একটা ধারে না, ক্রিশ্চিয়ানও অনেকটা তেমনি। তবু আমার মনে হলো ওরাও যেন লজ্জা পেল ক্যাপ্টেমকে অমন জঘন্য খাবার বুভুক্ষুর মত খেতে দেখে। ভাষ্টেনের ডান দিকে বসেছে ক্রিশ্চিয়ান, বাঁ দিকে ফ্রায়ার, আর আমি সামনে। কিছুক্ষণ সাধারণ টুকটাক আলাপের পর কথার মোড় ঘুরে গেল বাউন্টির নাবিকদের দিকে।
জাহান্নামে যাক সব! বললেন ব্লাই; মাংস আর কলাই ভর্তায় ভর্তি তার মুখ, দ্রুত চিবোতে চিবোতে জড়িত কণ্ঠে কথা বললেন তিনি। সব কটা বদমাশ, কুঁড়ের বাদশা! কি দেখে যে কর্তৃপক্ষ এদের বাছাই করল, বুঝতে পারি না… চিবোনো খাবারটুকু গিলে ফেলে আরেক গ্রাস মুখে পুরলেন ব্লাই। ওই যে বদমাশটা-কাল যাকে চাবুক মারলাম, কি যেন নাম, মিস্টার ফ্রায়ার?
প্রশ্নটা শুনে একটু লাল হলো মাস্টারের মুখ। বলল, বারকিট।
হ্যাঁ বারকিট, বেয়াদব কুকুর! বাকিগুলোও ওর মতই খারাপ। জাহাজের কাজ যদি এক বিন্দু বোঝে!
আমি কিন্তু, স্যার, আপনার সাথে একমত হতে পারছি না, ফ্রায়ার সবিনয়ে বলল। স্মিথ, কুইনটাল, ম্যাককয় সবাই প্রথম শ্রেণীর নাবিক, এমন কি ওই বারর্কিটও, যদিও ছোকরা ভুল