আশ্চর্য ব্যাপার, আমরা যখন নোঙ্গর ফেললাম একটা ক্যানোও এল না আমাদের-জাহাজের কাছে। সৈকতের ওপর অল্প কয়েক জন মানুষকে কেবল দেখলাম। উত্তেজনা বা আনন্দ নয়, কেমন যেন বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তাহলে কথাটা ঠিক! কদিন আগে পোর্ট জ্যাকসন-এ এক মিশনারির কাছে শুনছিলাম, যুদ্ধ এবং ইউরোপীয় নাবিকদের সাথে আসা রোগ ব্যাধিতে তাহিতির চার পঞ্চমাংশ জনসংখ্যাই নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কথাটার তাৎপর্য তখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি। আজ নিজের চোখে দেখে পারলাম। মনে পড়ল বাউন্টি যেদিন প্রথম নোঙ্গর ফেলেছিল এখানে সেদিনকার দৃশ্য। হাজার হাজার ক্যানন ঘেঁকে ধরেছিল আমাদের। চারদিকে-সাগরে, ডাঙায় সেদিন ছিল প্রাণের ছড়াছড়ি। আর আজ! তাহিতির সেই চির সবুজ প্রকৃতিও যেন আর তেমন নেই। কেমন হলদেটে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।
অবশেষে অনেকক্ষণ পর একটা হোট জোড়া তালি দেয়া ক্যানো এসে ভিড়ল কুরিওজের গায়ে। দুজন লোক তাতে। ছেঁড়াছোঁড়া ইউরোপীয় পোশাক তাদের পরনে। এক পলক দেখেই বুঝলাম লোকদুটো ভিক্ষুক ছাড়া কিছু নয়। আমাদের দেয়া উপহরের বিনিময়ে কিছুই দিতে পারল না ওরা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা শুরু করল। আমি জবাব দিলাম ওদের ভাষাতেই। টিপাউ, পইনো এবং হিইিহিটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে কাঁধ ঝাঁকুনি আর বিস্মিত দৃষ্টি ছাড়া কিছু পেলাম না।
সূর্যাস্তের ঘন্টা খানেক আগে আমার লোকেরা হিটিহিটির পয়েন্টে নামিয়ে দিল আমাকে। ওদের অপেক্ষা করতে বলে আমি এগিয়ে গেলাম দ্বীপের ভেতর দিকে। একটা মানুষ দেখতে পেলাম না। আমার তাইওর বাড়ির কোন চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। যেখানে হিটিহিটির উঠান ছিল সে জায়গাটা এখন আগাছায় পূর্ণ। ফারেরোই-এর মন্দিরে যাওয়ার পথটারও এক দশা। এখানে যে কোন কালে পথ ছিল অনেক কষ্টে তা কল্পনা করে নিতে হয়।
সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওনা হলাম তেহানির সাথে যেখানে দেখা হয়েছিল সেই নদীমুখের দিকে।
যেখানে বসে আমি সূর্যোদয় দেখতাম ঠিক সেখানে বসে আছে এক বৃদ্ধা। দূর সাগরের দিকে দৃষ্টি। ধীর পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। চমকে মুখ তুলে তাকাল বৃদ্ধা। আমি হিতীয় ভাষায় কথা বলতেই মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। হিটহিটি? হ্যাঁ, লোকটার নাম সে শুনেছে, অনেক বছর আগে মারা গেছে এই গোত্রপতি। হিনা মাথা নাড়ল বৃদ্ধা। টিপাউ-এর নামও কখনও শোনেনি। তবে পইনোর কথা ভালই মনে আছে তার। ডাকসাইটে যোদ্ধা ছিল। মারা গেছে সে-ও। সামান্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বৃদ্ধা বলল, তাহিতি এক কালে মানুষের দেশ ছিল, এখন ছায়া ছাড়া কিছু নেই।
.
পরদিন সকালে জনা বারো লোক নিয়ে পানসিতে করে টউিতিরার পথে রওনা হলাম আমি। দ্বীপটার পূর্ব উপকূল মাতাভাইয়ের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থায় আছে মনে হলো। যুদ্ধ ভেহিয়াটুয়ার রাজ্যের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারেনি। তবে মড়ক তার কাজ ভাল মতই সম্পন্ন করেছে। আগে, আমি যখন ছিলাম তখন যেখানে পঞ্চাশ জন লোক দেখা যেত এখন সেখানে দশ জনেরও দেখা পাওয়া ভার।
ভেহিয়াটুয়ার রাজ্য অক্ষত আছে কিন্তু বাড়ি নেই। সাগরতীরে যেখানে ছিল উঁচু বাড়িটা সেখানে এখন হিটিহিটির বাড়ির মতই আগাছার জঙ্গল। তবে আশ্চর্য ব্যাপার, আমার বাড়িটা আছে। কি করে এটা সম্ভব হয়েছে আমি জানি না।
পানসি ডাঙার মাটি স্পর্শ করল। জনা বিশেক নারী পুরুষ এগিয়ে এল আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। এক এক করে প্রত্যেকটা লোকের মুখ নিরীক্ষণ করলাম আমি। এক জনকেও পরিচিত মনে হলো না। তেহানির কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না আমার। পোর্ট জ্যাকসনের সেই মিশনারীটির মুখে শুনেছিলাম তেহিয়াটুয়া মারা গেছে। তার পরিবারের অন্যদের খবর জিজ্ঞেস করার সাহস তধন হয়নি, এখনও হলো না। আমার লোকদের কিছু নারকেল কেনার জন্যে দরদাম করার নির্দেশ দিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম আমাকে চেনে এমন কারও খোঁজে।
বহুদিন আগের পরিচিত পথেই এগোলাম। হ্যাঁ, আমার বাড়ির দিকে। অর্ধেক পথও যাইনি, এমন সময় হোমরা চোমরা চেহারার মাঝ বয়েসী এক লোকের সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। দুজনের চোখ এক হলো! মুহূর্তের জন্যে কোন কথা বলতে পারলাম না দুজনের কেউ।
তুয়াহু। আমি প্রশ্ন করলাম।
বিয়্যাম! ছুটে এসে ইন্ডিয়ান রীতিতে আলিঙ্গন করল আমাকে তুয়াহু। আবার যখন মুখ তুলল, দেখলাম ওর চোখে জল। আমার হাত ধরে বলল, এসো, বাড়িতে এলো।
বাড়িতেই যাচ্ছিলাম, আমি বললাম। কিন্তু তার আগে চলো, এমন কোথাও যাই যেখানে আমরা একটু একা থাকতে পারব।
আমার মনের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারল তুয়াহ। বলল, এখানেই বলতে পারো যা বলতে চাও। এপথে এখন আর বেশি লোক চলাচল করে না।
অনেকক্ষণ ধরে সাহস সঞ্চয় করলাম আমি। অবশেষে করলাম প্রশ্নটা:
তেহানি কই?
উয়া মাতে–মারা গেছে, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল তুয়াহু। তুমি চলে যাওয়ার তিন চাঁদ পর মারা গেছে ও।
আমাদের বাচ্চা? দীর্ঘ নীরবতার পর আবার আমি প্রশ্ন করলাম।
ও বেঁচে আছে। এখন পরিপূর্ণ নারী। ওর নিজেরও একটা বাচ্চা হয়েছে। আতুয়াই-এর ছেলেকে ও বিয়ে করেছে। একটু দাঁড়াও দেখতে পাবে তোমার মেয়েকে।
বন্ধু, তুমি জানো ও কতখানি প্রিয় আমার। এই এতগুলো বছর আমি স্বপ্ন দেখেছি ফিরে আসব, ফিরে আসব। পারিনি। আমার দে একটানা জড়িয়ে থেকেছে যুদ্ধে। এই জায়গা এখন আমার কাছে স্মৃতির কবরখানা। মেয়েকে আমি দেখতে চাই, তবে-তবে আমার পরিচয় না দিয়ে। আজ এত বছর পর পিতৃত্বের দাবি নিয়ে ওর সামনে দাঁড়াতে, ওকে বুকে জড়িয়ে নিতে, ওকে ওর মায়ের গল্প শোনাতে আমি পারব না, তুয়াহু। বুঝতে পারছ আমার কথা?