ঝড় থেমে গেলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই সান্তাক্রুজের উপকূল তখন অশান্ত। বিরাট বিরাট ঢেউ ভেঙে পড়ছে বালুকাবেলায়। দর দাম করে বেশ কয়েকটা উপকূলীয় নৌকা ভাড়া করলেন লেফটেন্যান্ট ব্লাই। এবং নৌকার মাঝিদেরকে দায়িত্ব দিলেন আমাদের পানি এবং খাবার দাবার সরবরাহের। নিজের লোকদের উদয়াস্ত ব্যস্ত রাখলেন ঝড়ে জাহাজের যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামতের কাজে। এখানেই শুরু অসন্তোষের। আমাদের কিছু নাবিক আশা করেছিল নৌকাগুলো মেরামত করে একদিনের জন্যে হলেও তীরে যাবে। নিজেরা পছন্দ করে কিনে আনবে খাবার দাবার, মদ; সবচেয়ে বড় যেটা প্রায় দেড়মাস পর অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও পা রাখতে পারবে ডাঙার। মাটিতে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের সিদ্ধান্ত যখন ওদের এই আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিল তখন ক্ষুব্ধ না হয়ে পারল না ওরা।
নোঙ্গর ফেলার পর প্রথম যেদিন ভাঙা থেকে খাবার এল, সেদিন থেকেই নোনা মাংসের বদলে তাজা মাংস পরিবেশন শুরু হলো খাবার সময়। এই ঘটনায় অসন্তোষ একটু বাড়ল নাবিকদের ভেতর। বউন্টির নুন দেয়া মাংস খুব একটা সুস্বাদু কিছু নয়। আমার ধারণা দুনিয়ার সবচেয়ে বাজে নোনা মাংস ওগুলো কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে, টেনেরিফ থেকে এনে যে তাজা মাংস আমাদের খাওয়ানো হলো তার মান আরও খারাপ। কয়েকজন নাবিক তো ঘোষণাই করে বসল, এ মাংস মরা ঘোড়া বা খচ্চরের না হয়েই যায় না। মাস্টারের কাছে অভিযোগ করল তারা, এ মাংস খাওয়ার অনুপযুক্ত।
অভিযোগগুলো যথাসময়ে ক্যাপ্টেনের কানে তুলল ফ্রায়ার। শুনে ভয়ানক রেগে গেলেন ব্লাই। সবাইকে ডেকের ওপর জড় করে বলে দিলেন, হয় তারা তাজা মাংস খাবে, নয় তো না খেয়ে থাকবে। ফল হলো রান্না করা তাজা মাংসের বেশির ভাগই নাবিকরা ছুঁড়ে ফেলে দিল সাগরে। অনেকে ক্যাপ্টেনের সামনেই করল কাজটা। রাগে ভেতরে ভেতরে টগবগ করে ফুটলেও ওপরে কোন ভাবান্তর দেখালেন না ব্রাই।
টেনেরিফ থেকে রওনা হবার পর পরই জাহাজের নাবিকদের তিনটে চৌকিতে (Watch) বিভক্ত করলেন ব্লাই। এতদিন নাবিকরা বারো ঘন্টা করে কাজ কর এখন থেকে করবে আট ঘণ্টা করে। মাস্টারের মেট ক্রিশ্চিয়ানকে পদোন্নতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট করলেন, এবং তৃতীয় চৌকির দায়িত্ব দিলেন তাকে (সুষ্ঠুভাবে জাহাজ পরিচালনার স্বার্থে এ ধরনের পদোন্নতি দেয়ার ক্ষমতা ব্লাইকে দিয়েছে অ্যাডমিরালটি)। জাহাজের সবাই ক্রিশ্চিয়ানকে ব্লাইয়ের বন্ধু বলেই জানে। যদিও সেই বন্ধুত্বের স্বরূপ বড় অদ্ভুত। একদিন যদি ব্লাই ক্রিশ্চিয়ানকে ডেকে নিজের সঙ্গে খাওয়ান তো পর দিনই সবার সামনে তাকে রুক্ষ ভাষায় গালিগালাজ করেন; কখনও কখনও বিনা কারণে। ব্লাই খ্যাপাটে স্বভাবের মনে করে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে ক্রিশ্চিয়ান। তবে পদোন্নতি দিয়ে সত্যি সত্যিই ক্রিশ্চিয়ানের মস্তবড় একটা উপকার করেছেন ব্লাই। সব কিছু যদি ঠিকঠাক মত থাকে, ক্রিশ্চিয়ান যদি শেষ পর্যন্ত ক্লাইয়ের মন জুগিয়ে চলতে পারে তাহলে দেশে ফেরার পর অ্যাডমিরালটি ওর পদোন্নতিটা পাকাপাকি ভাবে বহাল করবে। সাধারণত এমনই ঘটে থাকে।
অর্থাৎ ক্রিশ্চিয়ান এখন থেকে অফিসার। শুধু অফিসারই নয়, ফ্রায়ারের সমমর্যাদার অফিসার। কাল যে অধীনস্থ ছিল আজ তাকে সহযোগী হিসেবে দেখতে কারই বা ভাল লাগে? ফ্রায়ারেরও লাগল না। বাইরে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে ভয়ানক ক্ষুব্ধ হলো সে-পদোন্নতি পেয়েছে বলে ক্রিশ্চিয়ানের ওপর, আর পদোন্নতি দিয়েছেন বলে ব্লাইয়ের ওপর। অসন্তোষের আরেকটা বীজ রোপিত হলো এভাবে।
জাহাজের প্রতিটা লোককে ডেকের ওপর ডেকে ক্রিশ্চিয়ানের পদোন্নতির খবর শোনালেন ব্লাই, এবং জানিয়ে দিলেন, এখন থেকে ওকে অফিসার হিসেবে মেনে চলতে হবে। এরপর কিছু কথা তিনি বললেন নাবিকদের উদ্দেশ্যে:
প্রথমেই আমরা একমাস পিছিয়ে গেছি প্রতিকূল বাতাসের কারণে, শুরু করলেন ব্লাই। তারপর ঝড়েও বেশ কিছু দিন সময় নষ্ট হয়েছে। ঝড় আমাদের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা করেছে, আমাদের ভাণ্ডারের প্রায় অর্ধেক খাবার নষ্ট করে দিয়েছে, মদেরও একটা বড় অংশ ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কত দিন আমাদের সাগরে থাকতে হবে তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। সামনে আবার ঝড়ে পড়ে আরও সময় নষ্ট হতে পারে, আরও খাবার নষ্ট হতে পারে। তাহিতি থেকে রুটিফলের চারা সংগ্রহের জন্যে আমরা যে সময় হিসেবে ধরেছি বাস্তবে লেগে যেতে পারে তার চেয়ে বেশি। দেড় বছরের মত খাবার আমরা সঙ্গে এনেছিলাম, কিন্তু দেড় মাসেই তা কমে এক বছরের পরিমাণে নেমে এসেছে। সুতরাং, এখন থেকেই যদি মিতব্যয়ী না হই, শেষ পর্যন্ত হয়তো বিপদে পড়ে যাব আমরা। তাই আমি আজ থেকে আমাদের মাথাপিছু রুটির বরাদ্দ এই ততীয়াংশে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছি।
মিতব্যয়িতার প্রয়োজন উপলব্ধি করে সবাই সানন্দে মেনে নিল এ নির্দেশ। কিন্তু নোনা মাংস আর শুয়োরের মাংস সম্পর্কে ওদের অভিযোগ রয়েই গেল।
আমাদের জাহাজে কোন ভাণ্ডার রক্ষক নেই। কেরানী স্যামুয়েলের সহযোগিতায় ব্লাই নিজেই চালিয়ে নেন কাজটা। ছোট খাটো মানুষ স্যামুয়েল। চেহারায় ইহুদি ইহুদি ভাব। সবার বিশ্বাস লোকটা ক্যাপ্টেনের টিকটিকি। জাহাজের কোথায় কি হচ্ছে-সব কিছুর ওপর সে চোখ রাখে এবং সময় মত জানায় ক্যাপ্টেনকে। এ কারণে জাহাজের সবাই তাকে অপছন্দ করে। অনেকে মনে করে এই স্যামুয়েলের সহযোগিতায় লেফটেন্যান্ট ব্লাই জাহাজের জিনিসপত্র চুরি করেন। যদি তা না হয় তাহলে বলতে হবে ব্লাইয়ের প্রশ্রয়ে স্যামুয়েলই চুরি করে। বাবুর্চিদের কাছে খাবার দাবার সরবরাহের দায়িত্ব স্যামুয়েলের। প্রত্যেক বার যখন সে নুন দেয়া-মাংস বের করে, সবচেয়ে ভাল অংশটা রেখে দেয় কেবিনের জন্যে (কেবিনের জন্যে মানে ক্যাপ্টেন ও তার সহভোজীদের জন্যে)। বাকিটুকু, মানের দিক থেকে তা যেমনই হোক, না মেপে দিয়ে দেয় বাবুর্চিদের কাছে। দেয়ার সময় না মাপলেও মুখে একটা ওজনের কথা ঘোষণা করে স্যামুয়েল, এবং খাতায় লিখে রাখে ওজনটা। হয়তো দেখা গেল চার পাউন্ড ঘোষণা করে যে মাংস সে দিল তার ওজন কিছুতেই তিন পাউন্ডের বেশি হবে না। কিন্তু খাতায় লিখে রাখল চার পাউন্ড মাংস বেরিয়ে গেল ভাড়ার থেকে। এ সম্পর্কে কেউ কোন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করতে গেলে নির্ঘাত দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাকে। শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা ব্লাই নেবেনই প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে।