কোনটাই না, স্যার, আমি জবাব দিলাম। ঠিক করেছি আমি তাহিতিতেই ফিরে যাব।
আমার কথা শুনে ভয়ানক অবাক হলেন দুজন। কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বলতে পারলেন না।
ইংল্যান্ডের প্রতি আমার কোন আকর্ষণ আর নেই, আবার বললাম আমি।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন স্যার জোসেফ। তুমি যে তাহিতিতে ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো জাহাজের কাজ ছেড়ে আবার লেখাপড়ায় লেগে যাবে। কিন্তু তাহিতি…না!
কেন নয়, স্যার? দেশে কোন বাঁধন, কোন দায় দায়িত্ব আমার নেই। এক মা ছিল, সে-ও মরে গেছে। তাহলে আর কেন?
উহুঁ, কথাটা তুমি ঠিক বললে না, বিয়্যাম, মদের গেলাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে ক্যাপ্টেন মন্টাগু বললেন। দেশে কোন আপনজন নেই বলে কোন দায় দায়িত্বও নেই এটা কিন্তু ভুল। যে ঘটনাটা ঘটে গেল, এর ফলে বিশেষ একটা দায়িত্ব চেপেছে তোমার কাঁধে।
মানে! কিসের দায়িত্ব
তোমার মৃত বাবা মায়ের সম্মানের দায়িত্ব, স্মৃতির দায়িত্ব। বিদ্রোহের মত জঘন্য অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলে তুমি। যদিও বেকসুর খালাস পেয়েছ তর, আগামী দিনগুলোয় তোমার নামের সাথে সামান্য হলেও-কি বলে ওকে?-কালিমা লেগে থাকবে। তোমার আগামী দিনের কাজের ওপর নির্ভর করবে এই কালিমা চিরদিন থেকেই যাবে না ধীরে ধীরে হালকা হতে হতে মিলিয়ে যাবে। যদি ডাঙার কোন কাজ বেছে নাও বা তাহিতিতে ফিরে যাও, মানুষ বলবে, রজার বিয়্যাম? হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি, বাউন্টির বিদ্রোহী গুণ্ডাদের একজন তো-সামরিক আদালতে বিচার হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে কেমন করে যেন ছাড়া পেয়ে গেল। জনমতের একটা আলাদা শক্তি আছে, বিয়্যাম। ইচ্ছে করলেই সে শক্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
জাহান্নামে যাক জনমত, একটু উষ্ণ কণ্ঠেই আমি বললাম। আমি নির্দোষ এবং আমার রাবা-মা-মৃত্যুর ওপারে যদি জীবন থেকে থাকে তো এতদিনে নিশ্চয়ই জেনে গেছে একথা। সুতরাং অন্যরা যা খুশি ভাবুক, আমি, গ্রাহ্য করি না।
তুমি আসলে পরিস্থিতির শিকার হয়েছ, সহানুভূতির সুরে বললেন ক্যাপ্টেন মন্টা। তার ওপর পেয়েছ চরম দুর্ব্যবহার আর অপমান। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তবে এটাও ঠিক, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি যা ভাবছ তা ঠিক নয়। আমার-এবং স্যার জোসেফেরও ধারণা, জাহাজের চাকরিই তোমার জন্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে উপযোগী হবে। তোমার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তা সারিয়ে তুলতে হলে এর চেয়ে ভাল আর কোন পথ নেই। বাতাসে যুদ্ধের গন্ধ। তাতে অংশ নেয়াই যথেষ্ট হবে, দুদিনেই তোমার সম্পর্কে সব কানাকানি বন্ধ হয়ে যাবে। আর যদি যোগ্যতা দেখাতে পারো তো কথাই নেই।
এক মুহূর্তের জন্যে থামলেন ক্যাপ্টেন অন্টা। তারপর বলে চললেন, শোনো, বিয়্যাম, সোজাসুজিই বলছি, আমি তোমাকে হেকটর-এ চাই। লোকৈর দরকার আছে আমার, সেই লোকটা যদি তুমি হও সত্যিই খুশি হব আমি।
এরকম একটা প্রস্তাব এমন আচমকা হাজির হবে ভাবতে পারিনি। ইতস্তত করতে লাগলাম আমি।
হ্যাঁ, বিয়্যাম এটাই সবচেয়ে ভাল হবে তোমার জন্যে, বললেন স্যার জোসেফ।
ভাল তো হবে। কিন্তু, স্যার, বিড় বিড় করলাম আমি। স্যার, আপনার প্রস্তাবটা লোভনীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু-
এক্ষুণি তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না, বাধা দিয়ে বললেন স্যার মন্টাগু। ব্যাপারটা নিয়ে ভাল মত চিন্তা ভাবনা করো। এক মাসের ভেতর জানালেই চলবে, ততদিন আমি লোক নেব না।
হ্যাঁ, ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও, স্যার জোসেফ বললেন। আজ আর এ নিয়ে কোন কথা আমরা বলব না।
.
পর দিনই আমি রওনা হলাম কাম্বারল্যান্ডের পথে, ক্রিশ্চিয়ানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্যে। সেখান থেকে উইদিকম্বিতে আমার বাড়িতে।
মাসের শেষ নাগাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ক্যাপ্টেন মন্টাগুর প্রস্তাব গ্রহণ করব আমি। হেকটরে যোগ দেব নাবিক হিসেবে।
.
উপসংহার
১৭৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে আমি যোগ দিলাম ক্যাপ্টেন মন্টাগুর জাহাজে। পরের মাসেই ইউরোপ জুড়ে জ্বলে উঠল যুদ্ধের আগুন। বারো বছরের ভেতর সে আগুন আর নিভল না। এই বারো বছরে অসংখ্য নৌযুদ্ধে অংশ নিলাম আমি। বেশির ভাগই স্পেন উপকূলের অদূরে স্প্যানিশ আর্মাতার সাথে। এ ছাড়াও ক্যাম্পারডাউনে ডাচদের সাথে, ডেনদের সাথে কোপেনহ্যাগেন-এ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চদের সাথে ট্রাফালগার-এ যুদ্ধ করতে হলো। এই সময়ের ভেতর ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে আমি ক্যাপ্টেন হলাম।
যুদ্ধের পুরো সময়টায় আমি স্বপ্ন দেখেছি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় কোন শান্তিপূর্ণ উপনিবেশে বদলি হওয়ার। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে, বাস্তব আর হয়নি। বাস্তব হলো যুদ্ধ শেষ হওয়ার অনেক পর ১৮০৯ সালের গ্রীষ্মে, যখন ফরাশিদের কাছ থেকে দখল করা কুরিওজ নামের একটা ফ্রিগেটের দায়িত্ব দিয়ে নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পোর্ট জ্যাকসনের পথে রওনা হতে বলা হলো আমাকে। সেখান থেকে ভ্যালপারাইজো যেতে হবে। পথে দিন কয়েকের জন্যে থামতে হবে তাহিতিতে।
.
এপ্রিলের গোড়ার দিকে এক বিকেলে মাতাভাই উপসাগরে প্রবেশ করল আমার জাহাজ। দূরে তাহিতির তটরেখা দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির বন্যা উদ্বেল করে তুলল আমাকে। ওই তো ওখানে পয়েন্ট ভেনাস। তার ওপাশে ছোট্ট সেই দ্বীপটা-মোটু আউ। উল্টোদিকে হিটিহিটির বাড়ি। সামান্য দূরে স্টুয়ার্টের নিজ হাতে গড়া বাগান। পেগি এখন কেমন আছে ওদের মেয়ে? বীর পইনোর বাড়ি দেখতে পেলাম, মরিসন আর মিলওয়ার্ড থাকত ওখানে। কাছেই ভাইপুপু উপত্যকা থেকে নেমে আসা ছোট্ট নদী ভাইপুপুর মোহনা, যেখানে তেহানির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল আমার। কতদিন আগের কথা? তখন আমি কৈশোের ছাড়িয়ে যৌবনের দুয়ারে পা দিয়েছি সবে। আর এখন, প্রৌঢ়ত্বের প্রান্তসীমায়। আমার মেয়ে হেলেন এখন কতবড় হয়েছে?