এগারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি, এই সময় ক্যাপ্টেন মন্টাগু এলেন। সঙ্গে এক লেফটেন্যান্ট। মৃদু হাসি দুজনেরই মুখে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠতে চাইল কলজেটা। তাহলে কি…?
জেমস মরিসন, উইলিয়াম মুস্যাট, ডাকলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু।
এগিয়ে গেল দুজন। লেফটেন্যান্টের হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে ক্যাপ্টেন পড়লেন:
অ্যাডমিরাল অভ দ্য ব্লু এবং মহানুভব রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টিতে বিদ্রোহের ব্যাপারে তোমাদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদানকারী সামরিক আদালতের সভাপতি লর্ড হুড আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তোমাদের দোষী সাব্যস্ত করলেও বিদ্রোহকালীন কিছু বিশেষ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে তোমাদের মুক্তি দেওয়ার আন্তরিক আবেদন জানিয়েছিলেন মহানুভব রাজার কাছে। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে মহানুভব রাজা তোমাদের বেকসুর খালাস প্রদান করছেন।
রজার বিয়্যাম!
দুই সাথীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।
গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের মহানুভব লর্ড হাই অ্যাডমিরালের দপ্তরের কমিশনার-পরিষদ মহানুভ রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টির সাবেক মিডশিপম্যান রবার্ট টিলারের জবানবন্দী ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে নিঃসংশয় হয়েছেন যে, যে অপরাধের দায়ে তোমার বিচার, দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ প্রদান সম্পন্ন হয়েছে সে অপরাধে তুমি অপরাধী নও। অতএব মাননীয় সর্ডের কমিশনার
পরিষদ সামরিক আদালতের রায় বাতিল করে তোমাকে নির্দোষ ও বেকসুর খালাস ঘোষণা করছেন।
এগিয়ে এসে আন্তরিকভাবে আমাদের প্রত্যেকের করমর্দন করলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু।
আমার মনে যে কত কথা এসে ভীড় করছে! কিন্তু বলার সময়, ধন্যবাদ, স্যার, ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না।
মরিসন বলল, আমার রাজার করুণা আমাকে মুক্তি দিয়েছে। মহানুভবের সেবায় আমি আমার আগামী দিনগুলো উৎসর্গ করব। লর্ড হুডের প্রতিও কৃতজ্ঞ থাকব আজীবন।
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু। এরপর আমি প্রশ্ন করলাম, আমরা এখন মুক্ত, স্যার? মানে যেখানে খুশি যেতে পারব? সন্দেহের সুর আমার গলায়।
হ্যাঁ। সেফটেন্যান্টের দিকে ফিরলেন ক্যাপ্টেন। কানিংহ্যাম, দেখ তো, এই ভদ্রলোকদের জন্যে একটা নৌকার ব্যবস্থা করা যায় কি না এক্ষুণি।
হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন মন্টার সঙ্গে আমরা ওপরে উঠে এলাম। কয়েক মিনিটের ভেতর লেফটেন্যান্ট কানিংহ্যাম এসে জানাল নৌকা তৈরি। বিদায় নেয়ার মুহূর্তে ক্যাপ্টেন মন্টাগু আমাকে বললেন, আশা করি শিগগিরই আমাদের আবার দেখা হবে, মিস্টার বিয়্যাম।
নেমে এলাম নৌকায়! দাঁড় টানতে শুরু করল নাবিকরা।
কতদিন পর আমরা মুক্ত মানুষ হিসেবে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি! কিন্তু আমাদের মনের অবস্থা তখন মুক্তির আনন্দ উপভোগ করার মত নয়। মাত্র দুশো পূজেরও কম দূরে নোঙ্গর করে আছে এইচ.এম.এস ব্রানসউইক। ওটার ওপরের ডেকে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে পৌঁছানো তিন জন মানুষ, আমাদেরই তিন সাথী। আর কয়েক মিনিটের ভেতর ফাঁসির দড়ি এ পৃথিবীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাবে মিলওয়ার্ড; বারকিট আর এলিসনকে।
.
হেকটর থেকে নেমে আসার আগে ক্যাপ্টেন মন্টাও একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমাকে। স্যার জোসেফের লেখা। কমিশনার-পরিষদের সিদ্ধান্ত জানার পরপরই অ্যাডমিরালটি দপ্তরে বসে তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন। এতক্ষণে পড়ার সুযোগ পেলাম চিঠিটা। স্যার জোসেফ লিখেছেন, লন্ডনগামী রাতের কোচে তিৰুটে আসন তিনি ভাড়া করে রেখেছেন আমাদের তিনজনের জন্যে। পুনশ্চ দিয়ে লিখেছেন: মিস্টার একাইন আশা করে আছেন, তুমি তার বাড়িতে উঠবে। আমার মনে হয় না বুড়ো মানুষটাকে আশাহত করা উচিত হবে তোমার। বিক্ষিপ্ত মনটা একটু শান্ত হলেই আমাকে খবর দিও। জরুরী একটা ব্যাপারে আমি তোমার সাথে আলাপ করতে চাই।
.
পরদিন সকালে লন্ডন কোচ স্টেশনে নেমেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় মিলাম আমরা। মরিসন আর মুস্যাট রওনা হয়ে গেল যার যার বাড়ির পথে। আমি রওনা হলাম ফিগ টি কোর্টে মিটার একাইন-এর বাড়ির দিকে।
মিস্টার এসকাইন আমার প্রয়াত বাবার বন্ধু এবং আমাদের পারিবারিক আইন উপদেষ্টা। একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম তার বাড়িতে। তার পর খবর পাঠালাম স্যার জোসেফের কাছে। জবাব এল কয়েক ঘণ্টার ভেতর। রাতে তাঁর সাথে খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন আমাকে স্যার জোসেফ।
সন্ধ্যার পর পৌঁছুলাম তাঁর বাড়িতে। দেখলাম আমি একা নই, হেকটরের ক্যাপ্টেন স্যার মন্টাও নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ঘটনাবলী কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বা নিতে যাচ্ছে এসব ব্যাপারে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম আমরা। করলাম না বলে বলা উচিত স্যার জোসেফ আর স্যার মন্টাই করলেন, আমি শুনলাম। ওঁদের কথাবার্তা শুনে আমার মনে হলো, খুব শিগগিরই যুদ্ধ বাধতে যাচ্ছে ইউরোপে। অবশ্য তাতে কিছু এসে যায় না আমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফিরে যাব তাহিতিতে-আমার হেলেনের কাছে, আমার তেহানির কাছে। সুতরাং ইউরোপ এখন রসাতলে গেলেও আমার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নেই।
ইউরোপ প্রসঙ্গ শেষ হতেই স্যার জোসেফ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করবে তুমি, কিছু ভেবেছ, বিয়্যাম নৌবাহিনীতে ফিরে আসবে না অক্সফোর্ডে যাবে আবার