আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি, বললাম, অবশ্য যদি যথেষ্ট সময় হাতে…।
এক মাসের ভেতর পারবে।
আশা করি।
বেশ, পাবে তুমি এক মাস। অ্যাডমিরালটিতে আমার সামান্য প্রভাব আছে, সেটুকু খাঁটিয়ে আমি আদায় করে নেব সময়।
এর পর আমার ফাঁসির আদেশ সম্পর্কে সসংকোচে সামান্য আলাপ করলেন স্যার জোসেফ। মূলত দুঃখ প্রকাশ করলেন। অরপর বিদায় নিলেন।
আমি কাজে ডুবে গেলাম আবার।
.
অক্টোবরের পঁচিশ তারিখ। এই নিয়ে চতুর্থ কি পঞ্চমবারের মত পড়ছি সদ্য সমাপ্ত ভূমিকাটা। করাঘাত হলো দরজায়। ধক করে উঠল বুকের ভেতর। কপালে শীতল ঘাম জমে উঠতে শুরু করেছে। প্রবটা শেষ করার পর থেকে দরজায় কোন শব্দ হলেই এমন হচ্ছে আমার।
ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই, কি প্রশান্তি! ডা. হ্যামিলটন দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়! বিচারের রায় হলো যেদিন তার পর এই প্রথম দেখা আমাদের। শিগগিরই নিউফাউন্ডল্যান্ড-এ চলে যাচ্ছেন ডাক্তার। তাই শেষ বারের মত এসেছেন আমাকে বিদায় জানাতে।
অনেকক্ষণ কথা বললাম আমরা। প্যানডোরা, গ্রেট ব্যারিয়ার রীফে তার বিধ্বস্ত হওয়া, সেখান থেকে ভোলা নৌকায় টিমোর-এ পৌঁছানো-সব প্রসঙ্গ এল, চলে গেল। অবশেষে ওঠার সময় হলো ডা:হ্যামিলটনের। আমার হাত ধরে সান্ত্বনাসূচক কিছু একটা বলার জন্যে সবে মুখ খুলেছেন, দড়াম করে খুলে গেল দরজা। হাঁপাতে হাঁপাতে ভেতরে ঢুকলেন স্যার জোসেফ।
বিয়্যাম! বিয়্যাম! কোন রকমে উচ্চারণ করলেন, তারপরই প্রবল আবেগে করুদ্ধ হয়ে এল ভার।
আমি অনুভব করছি, বরফশীতল কিছু একটা যেন উঠে আসছে আমার বুকের ভেতর থেকে গলার কাছে। ডা. হ্যামিলটন তাকাতে লাগলেন একবার স্যার জোসেফের দিকে, একবার আমার দিকে।
না…দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠলেন স্যার জোসেফ। তুমি যা ভাবছ তা না…একটু একটু… এক পা এগিয়ে দুহাতে আমার কাঁধ ধরলেন তিনি। বিয়্যাম…বিয়্যাম…টিঙ্কলার বেঁচে আছে…ওকে পাওয়া গেছে…এ-মুহূর্তে ও লন্ডনেই আছে!
বোসো, বিয়্যাম, ডা. হ্যামিলটন বললেন। কিন্তু তার কোন প্রয়োজন আসলে ছিল না। নিজের অজান্তেই আমি বসে পড়েছি মেঝেতে। আমার পা দুটো আর বইতে পারছিল না আমার ভার। ডা. হ্যামিলটন আমাকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। পকেট থেকে ব্র্যান্ডির ছোট একটা শিশি বের করে মুখ খুলে ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। বললেন, খাও।
স্যার জোসেফ টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে রুমাল দিয়ে কপাল মুছছেন।
আমাকে এক চুমুক খাওয়ার অনুমতি দেবেন না, ডাক্তার? বললেন তিনি।
দুঃখিত, স্যার, একদম খেয়াল ছিল না, বলে শিশিটা আমি এগিয়ে দিলাম তার দিকে।
স্যার জোসেফ শিশিতে মুখ লাগিয়ে এক চুমুক খেয়ে বললেন, খাসা জিনিস, ডাক্তার। যে কাজের জন্যে তৈরি ঠিক সে কাজেই লাগল আজ। আমার দিকে ফিরে যোগ করলেন, লন্ডন থেকে সোজা এখানে আসছি। কাল সকালে নাশতা করতে করতে টাইমস-এ চোখ বুলাচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল খবরটা। ছোট্ট খবর: স্যাফায়ার নামক একটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জাহাজ বন্দরে নোঙ্গর ফেলেছে। হাভানার কাছে বিধ্বস্ত ক্যারিব মেইড-এর কয়েক জন বেঁচে যাওযা নাবিককে উদ্ধার করে এনেছে ওটা। নাশতা করা মাথায় উঠল আমার। ছুটলাম বন্দরে। গিয়ে দেখি মাল নামাচ্ছে স্যাফায়ার। ক্যারিব মেইড এর নাবিকদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, ওরা আগের দিন সন্ধ্যায়ই তীরে চলে এসেছে। খোঁজাখুজি করে বন্দরের কাছেই এক সরাইখানায় পেলাম ওদের। টিঙ্কলার নামের কেউ ওদের ভেতর আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সরাই মালিক দেখিয়ে দিল এক লোককে। সে তখন দুলাভাই মানে ফ্রায়ারে বাসায় যাওয়ার জন্যে বেরোচ্ছে। কোন ওজর আপত্তিতে কান না দিয়ে ওকে আমার গাড়িতে তুলে সোজা নিয়ে গেলাম লর্ড হুডের কাছে। কপাল ভাল অ্যাডমিরাল শহরেই ছিলেন। সাড়ে দশটার সময় লর্ড হুড আর আমি টিঙ্কলারকে নিয়ে পৌঁছলাম অ্যাডমিরালটিতে। ওখানে টিস্কলারের জবানবন্দী নেয়ার সব আইনগত ব্যবস্থা পাকা করে সোজা চলে এসেছি এখানে। যতদিন
টিঙ্কলারের জবানবন্দী নেয়া হচ্ছে ততদিন ও অ্যাডমিরালটির হেফাজতে থাকবে।
আমি শুনলাম শুধু, জবাব দেয়ার মত কোন কথা খুঁজে পেলাম না।
এখন কি নতুন করে বসবে সামরিক আদালত? ডা. হ্যামিলটন জিজ্ঞেস করলেন।
না, সেটা সম্ভব নয়। অ্যাডমিরালটির কমিশনাররাই শুনবে টিঙ্কলারের বক্তব্য। তারপর যুক্তিযুক্ত মনে হলে তারা সামরিক আদালতের রায় অদলবদল করতে পারবেন। কমিশনারদের সে ক্ষমতা দিয়েছে আমাদের দেশের আইন।
.
বিশ
অক্টোবরের ছাব্বিশ তারিখ সকালে টমাস বারকিট, জন মিলওয়ার্ড আর টমাস এলিসনকে নিয়ে যাওয়া হলো এইচ.এম.এস, ব্রানসউইক-এ ফাঁসি দেয়ার জন্যে। বাকিরা অর্থাৎ মরিসন, মুসভ্যাট আর আমি, সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম আমাদের নেয়া হলো না। খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারলাম না। একবার ভাবলাম টিলারের বক্তব্য শুনে আমাদের ব্যাপারটা বোধ হয় পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে। আবার মনে হলো, না, এক সঙ্গে ছজনকে ফাঁসি দেয়া অসুবিধাজনক বলে আমাদের রেখে গেছে। আজই আরও পরে অথবা কাল আমাদের দণ্ড কার্যকর করা হবে। তার মানে কমপক্ষে আরও কয়েক ঘন্টা কাটাতে হবে। মৃত্যুর সময় গুনে। মরিসন আর আমি পায়চারি শুরু করলাম। মনটাকে ব্যস্ত রাখার-প্রাণান্ত চেষ্টায় ইন্ডিয়ান ভাষায় আমাদের তাহিতীয় বন্ধুদের সম্বন্ধে আলাপ করতে লাগলাম।