কাঠগড়ায় উঠে দাঁড়ালাম আমি।
বিচারক মণ্ডলীর সভাপতি লর্ড হুড জিজ্ঞেস করলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনে আর কিছু বলার আছে তোমার?
না, মাই লর্ড।
একই প্রশ্ন করা হলো আমাদের প্রত্যেককে। প্রত্যেকেই এক জবাব দিলাম। এর পর কিছুক্ষণের জন্যে দর্শকদের বেরিয়ে যেতে বলা হলো কক্ষ থেকে। আমরা-আসামীরাও বেরিয়ে এলাম। ডিউক-এর ডেকের ওপর অপেক্ষা করতে লাগলাম সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারায়।
সময় গড়িয়ে চলেছে। থম থম করছে আমাদের মুখ। নিচে কেবিনে বসে বারো জন মানুষ নির্ধারণ করছেন আমাদের ভাগ্য। দুরু দুরু করছে বুকের ভেতর। কি রায় দেবেন বিচারকরা
অবশেষে বিশাল কেবিনটার দরজা খুলে গেল আবার। দর্শকরা ঢুকল প্রথমে। তারপর শুনতে পেলাম, আমার নাম ডাকা হচ্ছে। কেমন অদ্ভুত অপরিচিত মনে হলো নামটা, যেন জীবনে আর কখনও শুনিনি।
খোলা তলোয়ার হাতে এক লেফটেন্যান্ট আর বেওনেট লাগানো মাস্কেটধারী চার রক্ষীর সঙ্গে ঢুকলাম আমি। বিচারকদের দীর্ঘ টেবিলটার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে ওরা দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। সভাপতি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
উঠে দাঁড়াল পুরো আদালত। নীরবে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করলেন আমাকে লর্ড হুড।
রজার বিয়্যাম, তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সপক্ষে আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রদত্ত তোমার বক্তব্য শ্রবণ এবং বিচার বিশ্লেষণ করে আদালত এই সিদ্ধান্তে এসেছে যে, তোমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিঃসংশয় প্রমাণিত হয়েছে। অতএক আদালত এই মর্মে রায় প্রদান করছে যে, কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ তুমি গ্রেট বৃটেনের আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। গলায় ফাঁস পরিয়ে মহানুভব রাজার কোন যুদ্ধজাহাজে তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। কোন জাহাজে এবং কবে কখন দণ্ড কার্যকর করা হবে তা নির্ধারণ করবে গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের মাননীয় লর্ড হাই অ্যাডমিরালের দপ্তরের দণ্ড কার্যকর-করণ বিষয়ক কমিশনার পরিষদ।
জানি আদালতের বক্তব্য শেষ, তবু আরও কিছু শোনার আশায় যেন দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। তারপর একটা কণ্ঠস্বর-কার আমি জানি না-বলল, আসামী এখন যেতে পারে। রক্ষীদের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম আমি বিশাল কেবিনটা ছেড়ে। আমার সঙ্গীদের কাছে এসে দাঁড়ালাম।
মরিসন জিজ্ঞেস করল, কি, বিয়্যাম?
ফাঁসি হবে আমার! শোনা মাত্র মরিসনের মুখের ভঙ্গি যে কেমন হলো, সে আমি জীবনে ভুলব না। অবশ্য বেশিক্ষণ আতঙ্কিত থাকার সুযোগ ও পেল না, ডাক পড়ল আদালতের সামনে।
একটু পরেই বেরিয়ে এল মরিসন। মুখটা ফ্যাকামে, তবে এখন অনেক সুস্থ সে। আমার পাশে এসে মৃদু হেসে বলল, সুযোগ থাকতে থাকতেই জীবনটাকে উপভোগ করে নেয়া উচিত, বিয়্যাম। একমুহূর্ত পরে যোগ করল, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, আমার মা যেন এতদিনে মরে গিয়ে থাকে।
এর পর গেল কোলম্যান। বেরিয়ে এল মুক্ত মানুষ হিসেবে। কোয়ার্টার ডেকের এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল ও। তারপর একে একে নরম্যান, ম্যাকইন্টশ, আর বায়ার্ন। ওরাও বেরিয়ে এল রক্ষী ছাড়া। তিন জনের মুখই উদ্ভাসিত হাসিতে।
বারকিট, এলিসন, মিলওয়ার্ড আর মুসভ্যাট দ্রুত গেল আর এল। চারজনকেই দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর আবার ডাকা হলো মরিসন আর মুস্যাটকে। জানানো হলো, ওদের বিষয়টা মহানুভব রাজার বিবেচনার জন্যে পাঠানো হবে। রাজা যদি ক্ষমা করেন তাহলে মুক্তি পাবে ওরা।
আর বেশিক্ষণ আমাদের ডিউক-এর ডেকে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো না। ফিরিয়ে আনা হলো হেকটর-এর গান রুমে। এখান থেকেই সকালে বেরিয়েছিলাম দশজন, এখন ঢুকলাম ছজন।
.
স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস দেখা করতে এলেন পরদিন বিকেলে। তাঁকে দেখেই অত এক স্বস্তি অনুভব করলাম আমি। দুহাতে আমার হাত ধরে একটু চাপ দিলেন তিনি। তারপর পেছন ফিরে সঙ্গে আসা নাবিকের কাছ থেকে মোটাসোটা একটা প্যাকেট নিয়ে খুলতে খুলতে বললেন:
বোসো, বিয়্যাম, তোমার এক পুরানো সঙ্গী এবং বন্ধুকে নিয়ে এসেছি। প্যাকেটটার দিকে ইশারা করলেন স্যার জোসেফ। বলো তো কি?
বিস্মিত হয়ে আমি দেখলাম, প্যাকেটটা থেকে বেরোল আমার তাহিতীয় ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণের পাঞ্জলিপি।
তোমার পাণ্ডুলিপি পুরোটা আমি পড়েছি, বলে চললেন স্যার সোজেফ। সত্যি কথা বলতে কি কাজটা এত ভাল করে করতে পারবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমি যা চেয়েছিলাম ঠিক তা-ই তুমি করেছ। এখন বলল, এটাকে ছাপাখানায় দেওয়ার উপযোগী করে তুলতে আর কতটা সময় নেবে তুমি?
মানে, স্যার, আপনি বলতে চাইছেন আমি আরও কাজ করব এটার ওপর?
তুমি করতে চাও?
চাই মানে! ফাঁসির দিন ক্ষণ ঠিক হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যস্ত থাকার জন্যে কিছু একটা কাজ ভীষণ দরকার আমার সারা দিন শুয়ে বসে থেকে মৃত্যুর কথা ভাবার ভেতর আর যা-ইখাক স্বস্তি বা শান্তি নেই মোটেই। বললাম, খুব খুশি হব, স্যার, কাজটা শেষ করার সুযোগ পেলে। এটার গুরুত্ব নিয়ে আমি ভাবছি না, আমি ভাবছি…
তুমি না ভাবলেও কাজটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, বাধা দিয়ে বললেন তিনি। অবশ্যই এটা শেষ করতে হবে। রয়্যাল সোসাইটি চায়, ছাপা বইটার শুরুতে একটা ভূমিকা থাকবে। সেই ভূমিকায় সাধারণ ভাবে আলোচিত হবে তাহিতীয় ভাষার মূল সূত্রগুলো; এবং ইউরোপীয় ভাষাগুলোর সঙ্গে তার সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্য। রয়্যাল সোসাইটি ভূমিকাটা লেখার দায়িত্ব দিতে চাইছে আমাকে। কিন্তু, কি করে আমি লিখব? তাহিতীয় ভাষা সম্পর্কে আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, ভাসা ভাসা। এই জ্ঞান নিয়ে এমন একটা প্রবন্ধ রচনা করা এক কথায় অসম্ভব। কেউ যদি এটা লিখতে পারে, সে তুমি।