কি করে বলবে? কথাটা যে ডাহা মিথ্যা।
আমারও তা-ই মনে হয়েছে, কিন্তু এই মিথ্যে কথাটা বলল কেন হ্যালেট? আচ্ছা, বিদ্রোহের সময় হ্যালেট আর হেওয়ার্ড কেমন আচরণ করছিল? শান্ত ছিল দুজনই?
ঠিক, উল্টোটা, স্যার। দুজনই ভয়ে কাঁপছিল। বার বার ক্রিশ্চিয়ানের কাছে মিনতি করছিল যেন লঞ্চে না পাঠানো হয় তাদের। শেষ পর্যন্ত যখন জোর করে লঞ্চে তুলে দেয়া হলো, দুজনই কেঁদে উঠেছিল হাউমাউ করে।
ভালো। এই কথাটা তোমার বের করে আনতে হবে। হ্যালেট বা হেওয়ার্ড যদি স্বীকার না-ও করে, অন্যদের মুখ থেকে বের করে আনবে। সেজন্যে এই প্রশ্নগুলো করবে- মিস্টার গ্রাহাম বলে গেলেন প্রশ্নগুলো। আমি লিখে নিলাম।
সন্ধ্যার সামান্য আগে উঠলেন মিস্টার গ্রাহাম। চলে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বক্তব্য তুমি নিজেই পড়ে শোনাতে চাও, না আমি পড়ে দেব তোমার হয়ে?
আপনিই বলুন কোনটা করলে ভাল হবে।
যদি মনে করো ঘাবড়ে যাবে না, তাহলে নিজেই পড়ো। তোমার কাহিনী তোমার মুখে শুনলে বিচারকদের মনে যেমন প্রতিক্রিয়া হবে অন্যের মুখে শুনলে তেমন না-ও হতে পারে।
.
সোমবার। সেপ্টেম্বর সতেরো।
ঠিক নটার সময় বসল আদালত এইচ.এম.এস ডিউক-এর বড় কেবিনে। বিচারক এবং দর্শকদের আসন গ্রহণের পর এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর মাস্টার অ্যাট-আর্মস ডাকল, রজার বিয়্যাম, হাজির?
উঠে লর্ড হুডের দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম আমি।
বিদ্রোহ ও দস্যুতার মাধ্যমে মহানুভব রাজার সশস্ত্র জাহাজ বাউন্টি দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে তোমার বিরুদ্ধে। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দী ও প্রশ্নোত্তর তুমি শুনেছ। এখন তোমার কোন বক্তব্য থাকলে শুনবে আদালত। তুমি তৈরি?
জি, স্যার।।
তাহলে ডান হাত উঁচু করো।
শপথ নিলাম আমি। তারপর তাকালাম স্যার জোসেফের দিকে। ভাবলাম তার দৃষ্টি হয়তো একটু সাহস যোগাবে আমাকে। কিন্তু তিনি তখন দুহাতে হাঁটু আঁকড়ে ধরে বসে আছেন, দৃষ্টি সোজা তার সামনে। আমার দিকে তাকাতে যেন ভয় পাচ্ছেন তিনি। হঠাৎ কেমন এক আতঙ্ক ভর করল আমার মনে। ঘরের প্রতিটা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভাবতেই অদ্ভুত এক কাপুনি অনুভব করলাম শরীরে। মুখগুলো ঝাপসা হয়ে এল আমার সামনে। তারপর, দূর থেকে ভেসে আসা অন্য মানুষের কণ্ঠস্বরের মত শুনতে পেলাম আমার গলা:
মহামান্য আদালতের মাননীয় সভাপতি ও বিচারক মণ্ডলী, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা অতি গুরুতর। আমি জানি এই অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে মানুষের মনে আতঙ্ক আর ঘৃণা ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি জাগতে পারে না। তবু ভাগ্যের এমনই নির্মম লিখন, আমার বিরুদ্ধে উঠেছে এই অভিযোগ। আমি জানি আদালতে যে সব সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করা হয়েছে, সব আমার বিরুদ্ধে। আমাকে নিঃসংশয়ে নির্দোষ প্রমাণ করে এমন একটা কথাও বলা হয়নি। তবু মহান ঈশ্বর এবং মাননীয় বিচারক মণ্ডলীর সামনে আমি ঘোষণা করছি, আমি নির্দোষ। যে অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে তা সর্বৈব ভিত্তিহীন।
এ পর্যন্ত বলার পর একটু যেন সাহস ফিরে পেলাম আমি। দর্শকদের দিকে তাকালাম। তারপর মিস্টার গ্রাহামের পরামর্শ মত পড়ে গেলাম আমার লিখিত বক্তব্য শেষ করলাম এই কথাগুলো দিয়ে
মাননীয় সভাপতি ও বিচারক মণ্ডলী, যে তিনজন মানুষের সাক্ষ্য নিঃসংশয়ে প্রমাণ করতে পারত, আমি সত্যি কথা বলছি তারা সবাই আজ মৃত। আমার জন্যে অত্যন্ত দুঃখজনক যদিও, তবু কথাটা সত্যি। তাই আমি শুধু এটুকুই বলব, অনুনয় করে বলব, বিশ্বাস করুন আমার কথা! আমার সুনাম আমার কাছে আমার প্রাণের সমান। মাননীয় সভাপতি ও দ্রমহোদয়গণ, আমার পরিস্থিতিটা বিবেচনা করুন দয়া করে। আমি আপনাদের দয়ার ওপর ছেড়ে দিচ্ছি আমাকে?
আমার কথাগুলো বিচারকদের মনে কি প্রভাব ফেলল তার কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না তাদের মুখ দেখে। ডা, হ্যামিলটনের বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল আবার: বিচারকরা প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না!
আমি কি কোন প্রমাণ হাজির করতে পেরেছি আমার বক্তব্যের সপক্ষে? ভীষণ হতাশ আর ক্লান্ত বোধ করতে লাগলাম আমি।
স্যার জোসেফের দিকে তাকালাম। এখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দিয়েই যেন বুঝিয়ে দিতে চাইছেন: শাবাশ বেটা! মৃত্যুর কথা মনেও ঠাঁই দিও না! ওঁর দৃষ্টি নতুন করে শক্তি যোগাল যেন আমার শরীরে।
মহামান্য আদালত, আমি বললাম, এবার কি আমি সাক্ষীদের আবার প্রশ্ন করার সুযোগ পাব?
মাথা ঝাঁকালেন লর্ড হুড। মাস্টার-অ্যাট-আর্মস দরজার কাছে গিয়ে হাঁক ছাড়ল:
জন ফ্রায়ার! এই দিকে!
এল ফ্রায়ার। কাঠগড়ায় উঠে শপথ নিল। প্রশ্নের পালা শুরু করলাম আমি।
কোন কারণে আপনি যদি জাহাজে থেকে যেতেন এবং জাহাজ দখলের পরিকল্পনা করতেন, আমাকে কি জানাতেন সেই পরিকল্পনার কথা? (মিস্টার গ্রাহামের পরামর্শে আজ আবার করলাম প্রশ্নটা)।
হ্যাঁ, জবাব দিল ফ্রায়ার, জানাতাম। এবং প্রথম যাদের জানাতাম তাদের ভেতর থাকত ও।
লঞ্চ পানিতে নামানোর ব্যাপারে যারা সাহায্য করেছিল তাদের আপনি কি মনে করেন?-বিদ্রোহীদের সাহায্যকারী না ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সাহায্যকারী?
যাদের হাতে অস্ত্র ছিল না, আমি মনে করি, তারা ব্লাইকে সাহায্য করছিল।