ব্লাইয়ের জবানবন্দী পড়া শেষ হতেই আমি অনুভব করলাম, দর্শকদের-এবং বিচারকদেরও-বেশিরভাগের চোখ স্থির হয়ে আছে আমার ওপর। কারণটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। বিদ্রোহের হোতা ক্রিশ্চিয়ানের ডান হাত মনে করছে সবাই আমাকে।
একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ অবাক করল; কোলম্যান, নরম্যান আর ম্যাকইশ সম্পর্কে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি ব্লাই তাঁর জবানবন্দীতে। অথচ আমার বা আর সবার মত ব্লাইও জানতেন এই তিনজন তার সাথে যেতে চেয়েছিল লঞ্চে, বিদ্রোহীদের বাধার কারণে পারেনি। ওরা নির্দোষ-অন্তত ওরা তার সাথে আসতে চেয়েছিল এই কথাটা উল্লেখ করতে পারতেন তিনি জবানবন্দীতে। কেন যে এই নিরপরাধ লোকগুলোর ব্যাপারে ব্লাই মাথা ঘামাননি আজ পর্যন্ত আমি তার কারণ খুঁজে পাইনি।
যাহোক, এর পর ডাকা হলো বাউন্টির মাস্টার জন ফ্রায়ারকে। বিদ্রোহের দিন সকালে যেমন দেখেছিলাম এখনও তেমন আছে ফ্রায়ার। একটুও বদলয়ানি আদালতের নির্দেশে বাউন্টিতে বিদ্রোহ এবং তার পরের ঘটনাবলী সম্পর্কে জবানবন্দী দিল সে। আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে, সম্ভবত কিছু তার জানা ছিল না বলেই, কিছু না বললেও কোলম্যান, নরম্যান আর ম্যাকইন্টশ যে ব্লাইয়ের সঙ্গে আসতে চেয়েছিল তা সে বলতে ভুলল না।
জবানবন্দী শেষে আদালত জেরা করল ফ্রায়ারকে। জেরার এক পর্যায়ে তাকে প্রশ্ন করা হলো:
লঞ্চটা জলে নামাতে কত জন লোক দরকার হত?
জনা দশেক, ফ্রায়ারের জবাব।
আদালত আবার প্রশ্ন করল, বিদ্রোহের দিন ওটা নামানোর সময় আসামীদের কেউ হাত লাগিয়েছিল।
হ্যাঁ। মিস্টার বিয়্যাম, মিস্টার মরিসন, মিস্টার কোলম্যান, নরম্যান, ম্যাকইন্টশ সবাই হাত লাগিয়েছিল।
তুমি কি মনে করো, ওরা বিদ্রোহীদের সাহায্য করার জন্যে একাজ করেছিল, না ক্যাপ্টেন ব্লাইকে সাহায্য কার জন্যে?
আমার মনে হয় ওরা ক্যাপ্টেন ব্লাইকে সাহায্য করার জন্যেই একাজ করেছিল। প্রাণ বাঁচানোর একটা সুযোগ দিতে চেয়েছিল তাকে।
আমি জড়িত এমন কোন বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন করল না আদালত ফ্রায়ারকে।
জেরা শেষ হওয়ার পর আসামীদের সুযোগ দেয়া হলো সাক্ষীকে প্রশ্ন করার। তিনটে প্রশ্ন করলাম আমি।
আপনি যখন প্রথমবার ডেকে আসেন এবং ক্রিশ্চিয়ানের সাথে আমাকে আলাপ করতে দেখেন তখন কী বিষয়ে আমরা আলাপ করছিলাম, আপনি শুনেছিলেন?
ফ্রায়ারের জবাব, না, মিস্টার বিয়্যাম। সে সময়…
আদালতকে সম্বোধন করে দেবে সব প্রশ্নের জবাব, বাধা দিয়ে বললেন লর্ড হুড।
জি, বলে সভাপতির দিকে ফিরল ফ্রায়ার। না, কিছু শুনেছিলাম বলে আমার মনে পড়ছে না, মাননীয় আদালত।
আমি ক্রিশ্চিয়ানের দলে, আপনার মনে এমন বিশ্বাস জন্মানোর কোন কারণ কি ঘটেছিল? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন।
না, সোজা সাপ্টা জবাব ফ্রায়ারের।
আমার শেষ প্রশ্ন, আপনাকে যদি জাহাজে থাকতে দেয়া হত, এবং কখনও জাহাজ পুনর্দখলের পরিকল্পনা করতেন, আমাকে কি দলে নেয়ার কথা ভাবতেন?
অবশ্যাই ভাবতাম। আমার পরিকল্পনার কথা প্রথম যাদের কাছে প্রকাশ করতাম, মিস্টার বিয়্যাম হত তাদের অন্যতম।
এখানে এসে আবার প্রশ্ন করল আদালত, তুমি বলছ, মিস্টার বিয়্যাম ক্রিশ্চিয়ানের দলে তোমার মনে এমন বিশ্বাস জন্মানোর কোন কারণ ঘটেনি। কিন্তু তুমি যখন ডেকে এসে দেখলে ওর সাথে ক্রিশ্চিয়ান আলাপ করছে, তোমার মনে সন্দেহ জাগেনি?
না, কারণ সে সময় তার দলের নয় এমন অনেক লোকের সাথেই তাকে কথা বলতে দেখেছি।
বিদ্রোহের আগের রাতে তুমি যখন ডেকে চৌকিতে ছিলে, ক্রিশ্চিয়ান আর আসামী বিয়্যামকে এক সাথে দেখনি।
না, যতদূর আমার মনে পড়ে। আমার চৌকিতেই দায়িত্ব পালন করছিল মিস্টার বিয়াম। আমি যতক্ষণ ডেকে ছিলাম ও-ও ছিল। কিন্তু ওই সময়ের ভেতর ক্রিশ্চিয়ানকে একবারও ডেকে আসতে দেখিনি।
মিস্টার বিয়ামের সঙ্গে সে সময় কথা বলেছিলে তুমি?
হ্যাঁ, বেশ কয়েকবার।
ওকে কি চিন্তিত বা অস্থির লাগছিল।
একদম না।
ফ্রায়ারের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম আমি। কোন সন্দেহ নেই আদালতের সবাই বুঝতে পেরেছে ও আমাকে নিরপরাধ মনে করে।
মরিসন, এবং অন্য আসামীরা প্রশ্ন করল মাস্টারকে। তারপর জবানবন্দী দিতে ডাকা হলো সারেঙ মিস্টার কোলকে। ওর জবানবন্দী থেকে জানতে পারলাম, বিদ্রোহের দিন ভোরে ও আমাকে আর স্টুয়ার্টকে চার্চিলের পাহারায় বার্থে কাপড় পরতে দেখেছিল।
জবানবন্দীর পর আদালত এবং আসামীরা জেরা করল কোলকে। অবশেষে সেদিনের মত আদালত মুলতবী ঘোষণা করলেন সভাপতি। আবার আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হেকটর-এর গান রুমে।
মিস্টার গ্রাহাম এলেন। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলাপ করলেন আমার সাথে। আজকের জবানবন্দী ও সাক্ষ্য সমূহের বিচার বিশ্লেষণ করে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন পরের সাক্ষীদের কি কি প্রশ্ন করতে হবে। সব শেষে আমাকে হতাশ হতে বারণ করে বিদায় চাইলেন তিনি।
আর একটা প্রশ্ন করতে চাই, স্যার, আমি বললাম।
নিশ্চয়ই। একটা কেন যত খুশি করো।
স্যার, মন থেকে আপনি আমাকে কি মনে করেন?–দোষী না নির্দোষ
কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই জবাব দিতে পারি প্রশ্নটার। আমি তোমাকে নির্দোষ মনে করি।
.
পরদিন সকাল নটায় আবার শুরু হলো শুনানি।
বাউন্টির গোলন্দাজ পেকওভারকে ডাকা হলো প্রথমে। আগে জবানবন্দী দিল সে। তারপর শুরু হলো জেরা। আমার ব্যাপারে মাত্র দুটো প্রশ্ন করা হলো তাকে। বিদ্রোহের সকালে আমাকে দেখেছিল কিনা, আর আমি সে সময় কি করছিলাম। ঠিক ঠিক জবাব দিল পেকওভার। আদালতের জেরা শেষে আসামীদের সুযোগ দেয়া হলো প্রশ্ন করার। মরিসন প্রথমে করল। ও যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে ছিল না, বরং লঞ্চে খাবার দাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র তুলে দেয়ার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা বেশ ভাল ভাবে বের করে আনল পের্কওভারের মুখ দিয়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমার প্রশ্নগুলো বিশেষ কাজে গল না। আমার প্রশ্নের জবাবে পেকওভার জানাল, বিদ্রোহের আগের রাতে আমাকে আর ক্রিশ্চিয়ানকে ডেকের ওপর দেখেছে, কিন্তু আমাদের আলাপ সে শোনেনি। পরদিন বিদ্রোহের সময় মিস্টার নেলসনের সঙ্গে আমার যে কথাবার্তা হয়েছিল তা-ও সে শোনেনি।