না। হয় বেকসুর খালাস অথবা দোষী প্রমাণিত হওয়া এবং মৃত্যুদণ্ড ভোগ করা।
কিন্তু, স্যার, ধরুন এমন অবস্থা হলো, মরিসন বলল, একটা জাহাজে বিদ্রোহ হয়েছে, কিন্তু নাবিকদের একাংশ তাতে জড়িত তো নয়ই, সে সম্পর্কে জানতও নাকিছু তাদের কি হবে?
ওরা যদি বিদ্রোহীদের সাথে জাহাজেই থেকে যায়, আইন ওদের বিদ্রোহীদের সমান অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য করবে। আমাদের সামরিক আইন এ ব্যাপারে সত্যিই খুব কড়া। নিরপেক্ষতার কোন অবকাশ এখানে নেই।
কিন্তু স্যার, যোগ করল কোলম্যান, আমরা যারা ক্যাপ্টেন ব্লাইয়ের সঙ্গে লঞ্চে নেমে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু লঞ্চে জায়গা হয়নি বলে, বা বিদ্রোহীরা আটকে রেখেছিল বলে যেতে পারিনি, তাদের কি হবে?
এরকম পরিস্থিতি অবশ্যই বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে, জবাব দিলেন মিস্টার গ্রাহাম। সত্যিই যদি তোমরা তেমন কোন কারণে বিদ্রোহীদের সাথে থেকে গিয়ে থাকো আর আদালতের সামনে তা প্রমাণ করতে পারো তাহলে তো আমি তোমাদের খালাস না পাওয়ার কোন কারণ দেখি না।
আমি একটা প্রশ্ন করব, স্যার? এলিসন জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই।
আমি, স্যার, বিদ্রোহীদের একজন, যদিও যারা এর মূল উদ্যোক্তা তাদের সঙ্গে আমি ছিলাম না। অন্য সবার মত আমিও ক্যাপ্টেন ব্লাইকে পছন্দ করতাম না তাই বিদ্রোহীরা ওদের দলে যোগ দিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি যোগ দিয়েছি। পরিণাম নিয়ে ভাবিনি। আসলে পরিণাম সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না আমার। আমার কোন আশা আছে?
গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার গ্রাহাম। তারপর বললেন, এ সম্পর্কে কোন মতামত দেয়া এমুহূর্তে উচিত হবে না। প্রশ্নটার মীমাংসার ভার আদালতের ওপর ছেড়ে দেয়াই ভাল।
এর পর আমার সাথে বিস্তারিত আলাপ করলেন মিস্টার গ্রাহাম। ডা. হ্যামিলটন আর স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে যে কাহিনী শুনিয়েছি আর একবার তা শোনালাম। খুঁটিনাটি কিছু প্রশ্ন করলেন মিস্টার গ্রাহাম। তারপর বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, যেন না ঘাবড়াই, আমাকে বাঁচানোর জন্যে সাধ্যমত উনি করবেন।
তারপর জুলাই চলে গেছে, গেছে অগাস্ট। এখনও আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি।
.
সতেরো
সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ সকালে হেকটর থেকে এইচ.এম.এস. ডিউক-এ নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। সামরিক আদালত বসবে এই ডিউক-এর বড় কেবিনে।
বিশাল জাহাজ ডিউক। এর বড় কেবিনটাও তেমনি বিশাল। লম্বায় জাহাজের এমাথা ওমাথা, চওড়ায়ও এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত। আমরা যখন পৌঁছুলাম তখন মানুষে গিজগিজ করছে ডিউক-এর ডেক, কোয়ার্টার ডেক। বেশির ভাগই এ মুহূর্তে বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা যুদ্ধ জাহাজের অফিসার। পুরোদস্তুর ধরাচূড়া পরে আছে সবাই। অসামরিক লোকও আছে কিছু। তাদের ভেতর দেখলাম স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কসকে ডা, তামিলটনের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল উত্তমাশা অন্তরীপে। এতদিন পর আজ আরার তাঁকে দেখলাম, প্যানডোরার অন্যান্য অফিসারদের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন এক ধারে। এডওয়ার্ডসকেও দেখলাম। শীতল নিরাসক্ত দৃষ্টিতে দেখছে আমাদের।
ডেকের অন্য পাশে জড় হয়েছে বাউন্টির অফিসার নাবিকরা-যারা ব্লাইয়ের সঙ্গে ফিরে এসেছিল দেশে। মাস্টার মিস্টার ফ্রায়ার, সারেং কোল, ছুতোর মিস্ত্রী পার্সেল, গোলন্দাজ পেকওভগম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে সব, কজন। যখন শেষবার দেখেছিলাম ওদের তখনকার চেহারাটা ভেসে উঠল মনের পর্দায়। সেদিন আমরা কেউ কি ভেবেছিলাম, আবার আমাদের দেখা হবে, তা-ও আবার এমনি করে?
বিশাল কেবিনটার দরজা খুলে যেতেই সব গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। দর্শকরা ঢুকে একে একে বসে পড়ল তাদের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে। তারপর রক্ষীদের পেছন পেছন ঢুকলাম আমরা-আসামীরা। রক্ষীদের ইশারায় দাঁড়িয়ে গেলাম দরজার পাশে দেয়াল বরাবর। প্রথম দিনটা দাঁড়িয়েই কাটাতে হলে আমাদের। পরে অবশ্য শুনানী ও জেরার দৈর্ঘ্য বিবেচনা করে একটা বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
ঠিক নটার সময় আবার খুলে গেল দরজা। বিচারকমণ্ডলীর আগমন সংবাদ ঘোষণা করল মাস্টার-অ্যাট-আর্মস। উঠে দাঁড়াল দর্শকরা। বিচারকমণ্ডলী আসন গ্রহণ করার পর আবার বসল তারা। বিচারকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন পোর্টসমাউথ বন্দরে মোতায়েন রাজকীয় নৌ-বহরের সর্বাধিনায়ক ভাইস অ্যাডমিরাল অভ দ্য বু মাননীয় লর্ড হুড। সদস্য হিসেবে আছেন ক্যাপ্টেন স্যার অ্যান্ড মেপ হ্যামন্ড, ক্যাপ্টেন জন কলপয়জ, ক্যাপ্টেন সরি জর্জ মন্টা (হেকটরের ক্যাপ্টেন), ক্যাপ্টেন স্যার রজার কার্টিস, ক্যাপ্টেন জন ব্যাযেলে, ক্যাপ্টেন স্যার অ্যান্ড স্নেপ ডগলাস, ক্যাপ্টেন জন টমাস ডাকওয়ার্থ, ক্যাপ্টেন জন নিকলসন ইলফিল্ড, ক্যাপ্টেন জন নাইট, ক্যাপ্টেন আলবেরিলে বার্টি, ও ক্যাপ্টেন রিচার্ড গুডউইন কিটস।
এতগুলো দুদে লোককে এক সঙ্গে দেখে রীতিমত ভড়কে যাওয়ার অবস্থা আমার। ডা. হ্যামিলটনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল: আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে তো কিছু আসবে যাবে না। বিশ্বাস করাতে হবে বিচারককে। বিচারক প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করেন না।
শুরু হলো আদালতের কাজ।
একে একে আমাদের নাম ডেকে আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ পড়ে শোনান হলো। তারপর পড়া হলো ব্লাইয়ের লিখিত জবানবন্দী, যেটা তিনি দিয়েছিলেন দেশে ফেরার পর পরই। আমার সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানের সন্দেহজনক আলাপের কথা বর্ণনা করেছেন জবানবন্দীর একেবারে শেষ অনুচ্ছেদে।