ঢেউটা যখন ভেঙে পড়ে আমি তখন নিচে, আমাদের সার্জন ওল্ড ব্যাকাস এর সাথে আলাপ করছি তার কেবিনে বসে। অদ্ভুত লোক এই ওল্ড ব্যাকাস। একটা পা কাঠের। তুষারশুভ্র চুল, নীল চোখ। মুখ দেখলে মনে হয় সব সময় রেগে আছেন, অথচ আশ্চর্য নরম তার মন। ডাক্তারী সি করেই ভদ্রলোক যোগ দিয়েছিলেন জাহাজের চাকরিতে। তার গুর থেকে জাহাজেই আছেন। হাসতে হাসতে আমাকে বললেন, বুঝলে হে, বিয়্যাম, ডাঙার জীবন যে কেমন ভুলেই গেছি জাহাজে থাকতে থাকতে।
ওল্ড ব্যাকাস-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু উদ্ভিদবিজ্ঞানী মিস্টার নেলসন আর গোলন্দাজ পেকওভার। যুদ্ধ জাহাজের গোলন্দাজদের কাজের অন্ত নেই। কিন্তু বাউন্টি নামে যুদ্ধ জাহাজ হলেও কাজে বাণিজ্য জাহাজের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাই উইলিয়াম পেকওভারের সময় কাটে অলসভাবে। নিয়ম মাফিক সাধারণ কিছু তদারকি ছাড়া আর কিছু করতে হয় না তাকে। উদ্ভিদবিজ্ঞানী নেলসনও আপাতত কর্মহীন। রুটিফলের চারা জাহাজে ওঠানোর পর শুরু হবে তার কাজ। মিস্টার নেলসন বয়স্ক লোক। একটু চুপচাপ ধরনের। মাথা ভর্তি ধূসর চুল। সার্জনের সঙ্গে গল্প করে খুব মজা পান তিনি।
একটা বাক্সকে টুল বানিয়ে বসেছেপেকওভার। আমি আরেকটা বাক্সে।। সার্জন আর উদ্ভিদবিজ্ঞানী বসেছেন বিছানায়। ঢেউয়ের দোলায় দুলছে জাহাজ। বাতাসের ঝাঁপটায় কেঁপে উঠছে মাঝে মাঝে। এর ভেতরেই আলাপ করছি আমরা। নাবিক হিসেবে নতুন আমি। জাহাজের দুলুনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছে যদিও, তবুশান্তই রেখেছি মুখটাকে। নানা বিষয়ে কথা হতে হতে এক সময় সার্জনের
কাঠের পায়ের প্রসঙ্গ উঠল। আমার কৌতূহল মেটানোর জন্যে বহুবার বলা গল্পটা আবার বললেন ওন্ড ব্যাকাস-কবে, কোথায়, কেমন করে আসল পা-টা তিনি খুইয়েছিলেন। সব শেষে নেলসনের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, আমাদের এই পার্সেল, বুঝলেন, ছুতোর মিস্ত্রী হিসেবে জুড়ি নেই ওর।
কি করে বুঝলেন? কাজ দেখানোর কোন সুযোগই তো ও এখনও পায়নি।
পেয়েছে, পেয়েছে! রহস্যময় একটু হাসি হাসলেন সার্জন। আমার এই পা-টা ও-ই তৈরি করে দিয়েছে। একেবারে নিখুঁত কাজ। আমি বুঝতেই পারি এটা আমার আসল পা না নকল। উহ আগেরটা যা ভুগিয়েছে…!
আচমকা কেঁপে উঠল বাউন্টি। ওপর থেকে ভেসে এল খালাসীদের আর্তনাদ: গেল। গেল! গেল! তারপর অস্পষ্ট একটা চিৎকার: সবাই ডেকের ওপর! লাফ দিয়ে ছুটলাম ওপরে। ডেকে উঠতেই বাতাসের তীব্র ঝাঁপটা লাগল চোখে মুখে।
ব্লাইকে দেখলাম, পেছনের মাস্তুলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে ফ্রায়ার। চিৎকার করে সহকারীদের নানা রকম নির্দেশ দিচ্ছে সে। টালমাটাল অবস্থা জাহাজের। একবার এদিকে হেলে পড়ছে, একবার ওদিকে। তীর বাতাস ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলতে চাইছে পাল, মাল, দড়িদড়া। খালাসীরা প্রাণপণে পালের দড়ি কষে বাঁধার চেষ্টা করছে। এই সময় আমি দেখতে পেলাম বিশাল ঢেউটা। প্রায় উঠে পড়েছে জাহাজের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে হুইলে দাঁড়ানো লোকটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন ব্লাই। ত্রিশ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দাও হাল! ডান দিকে! তারপর মাস্তুলের মাথার দিকে তাকিয়ে: এই, তোমরা, উপরে! পালগুলো অর্ধেক করে গুটিয়ে ফেল! জলদি, ঢেউটা এসে পড়ার আগেই।
ব্লাইয়ের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম আমি। ঢেউয়ের মাথায় উঠিয়ে ফেলতে চাইছেন বাউন্টিকে। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পেলেন না। ঢেউটা আছড়ে পড়ল জাহাজের ওপর। আচমকা নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম পানির নিচে। তীব্র টান অনুভব করলাম শরীরে। ভাগ্য ভাল ঢেউটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে একটা দড়ি ধরে বসেছিলাম। না হলে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যেতাম নিশ্চয়ই। কতক্ষণ যে পানির তলে রইলাম জানি না। বাতাসের অভাবে যখন ফুসফুস ফেটে যেতে চাইছে তখন হঠাৎই সরে গেল পানি। প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে বাঁচলাম। একটু সুস্থির হয়ে তাকিয়ে দেখি ডেকের কোণে জড় করে রাখা বিয়ারের পিপেগুলো নেই। নৌকা তিনটেও যেখানে ছিল সেখানে আর নেই, উল্টে পড়ে আছে রেলিংয়ের পাশে। কয়েক জন খালাসী প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে আছে ওগুলোর রশি। আরও কি ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে হিসেব নিতে গিয়ে দেখা গেল, বাউন্টির পেছন দিকটায় ফাটল দেখা দিয়েছে কয়েকটা। সেইসব ফাটল দিয়ে নোনা পানি চুকছে ভঁড়ার ঘরে। আমাদের খাবার দাবারের বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে গেছে।
.
উনচল্লিশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে পৌঁছার পর ঝড় থেমে গেল। পরিষ্কার আকাশে ঝলমল করে উঠল সূর্য। সব কটা পাল তুলে দিয়ে টেনেরিফের দিকে চলল আমাদের জাহাজ।
জানুয়ারির চার তারিখে মরিশাসগামী এক ফরাশি বাণিজ্য জাহাজের সাথে দেখা হলো আমাদের। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় একদম ওপরের পালগুলো নামিয়ে ওটার নাবিকরা সম্মান জানাল বাউন্টিকে। পরদিন ভোরে, আমাদের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রায় বারো লিগ দুরে দেখতে পেলাম টেনেরিফ দ্বীপকে। টেনেরিফের ছোট্ট বন্দর সান্তাক্রুজের দিকে জাহাজ চালানোর নির্দেশ দিলেন ব্লাই। সান্তাক্রুজ উপকূলে পৌঁছুতে সময় লাগল পুরো একদিন এক রাত। অবশেষে নোঙ্গর ফেললাম আমরা একটা স্প্যানিশ আর একটা আমেরিকান জাহাজের কাছে।
পাঁচ দিন এখানে নোঙ্গর ফেলে রইলাম আমরা। এবং এখানেই রোপিত, হলো অসন্তোষের বীজ, যে অসন্তোষের কারণে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় বাউন্টির এই যাত্রা।