জুনের উনিশ তারিখে আমরা স্পিটহেড-এর অদূরে পৌঁছুলাম। সেদিনই সন্ধ্যার আগে পোর্টসমাউথ বন্দরে, নোঙ্গর ফেলল গরগন। বাউন্টিতে চেপে যেদিন পোর্টসমাউথ থেকে রওনা হয়েছিলাম তারপর চারবছর ছমাস কেটে গেছে, এর ভেতর প্রায় পনেরো মাস আমরা কাটিয়েছি শিকল বাঁধা অবস্থায়।
ষোলো
পৌঁছানোর এক দিন পর অর্থাৎ একুশ জুন, সতেরোশো বিরানব্বই আমাদের সরিয়ে নেয়া হলো এইচ, এম, এস হেকটর নামক এক যুদ্ধ জাহাজের গান রুমে। সামরিক আদালতে বিচার শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবে বন্দীরা।
হেকটরে ওঠার পর এক ঘণ্টাও পেরোয়নি। আমাকে ডেকে পাঠালেন জাহাজটার ক্যাপ্টেন মিস্টার মাগু। রক্ষীকে বিদায় করে দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। নানা বিষয়ে আলাপ করলেন কিছুক্ষণ। বিদ্রোহের প্রসঙ্গ একবারও তুললেন না। নিশ্চয়ই খোশ গল্প করার জন্যে আমাকে ডেকে পাঠাননি ভদ্রলোক। কিছু একটা কারণ আছে। কিন্তু কী, সেটা আন্দাজ করতে পারছি না। অবশেষে প্রায় আধঘণ্টা পর টেবিলের একটা দেরাজ খুলে একটা খাম বের করলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগুও। এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।
তোমার চিঠি, বললেন তিনি। এখানে বসে পড়ো। আমি চলে যাচ্ছি। কেউ বিরক্ত করবে না তোমাকে। বার্থে ফেরার সময় হলে শুধু দরজা খুলে রক্ষীকে বলবে, পৌঁছে দেবে।
বেরিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন মন্টাগু। কম্পিত হাতে আমি খুললাম চিঠিটা। স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস লিখেছেন। তারিখ দেখলাম গরগন পোর্টসমাউথে পৌঁছানোর কদিন আগের। চিঠিটা পড়তে পড়তে সারা শরীর অবশ হয়ে এল আমার। ছোট্ট একটা খবর দিয়েছেন স্যার জোসেফ: দুসপ্তা আগে আমার মা মারা গেছেন। খবরটা তাকে জানিয়েছে আমাদের পুরানো কাজের মেয়ে থ্যাকার। এরপর সান্ত্বনাসূচক কিছু কথা। খুব শিগগিরই আমার সাথে দেখা করতে আসবেন জানিয়ে চিঠি শেষ করেছেন তিনি।
চিঠিটা পড়ে একটা কথাই শুধু আমার মনে হলো, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। জীবনে মাত্র দুজন নারীর ভালবাসা পেয়েছি, কিন্তু তাদের প্রয়োজন আমার জীবনে যখন সবচেয়ে বেশি তখনই দুজনের একজনও নেই আমার পাশে। মা চিরতরে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে, স্ত্রী পড়ে আছে অর্ধেক পৃথিবী ওপাশে, জীবনে আর কোন দিন দেখা হবে কিনা, এই নিয়তিই বলতে পারে। মা নেই, বোধহয় সে কারণেই, তেহানির কথা আরও বেশি করে মনে পড়তে লাগল আমার। আমার বাচ্চা-আমার হেলেন, আর কখনও কি ওকে দেখব।
কয়েক দিন পর এলেন স্যার জোসেফ। আগের মতই আছেন ভদ্রলোক। হাসিখুশি, সদালাপী। জানালেন, মারা যাওয়ার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মা-কে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। কেমন দেখেছেন, কি কি কথা হয়েছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বললেন। ইচ্ছে মত প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন আমাকে। একই প্রশ্ন বার বার করলাম (বেশ কয়েক বার এমন হলো) প্রত্যেক বারই ধৈর্যের সঙ্গে জবাব দিলেন তিনি। তারপর সম্ভবত আমার মনকে ভারমুক্ত করার জন্যেই কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তাহিতীয় ভাষায় অভিধান ও ব্যাকরণের প্রসঙ্গ তুললেন। প্যানডোরা বিধ্বস্ত হলেও আমার পাণ্ডুলিপি খোয়া যায়নি শুনে তিনি একেবারে বাচ্চা ছেলের মত খুশি হয়ে উঠলেন।
চমৎকার, বিয়্যাম! চমৎকার! প্রায় চিৎকার করে বললেন স্যার জোসেফ। অন্তত একটা লাভ তাহলে হয়েছে বাউন্টিকে ওখানে পাঠিয়ে! কোথায় এখন ওগুলো?..
প্যানডোরার সার্জন ডা. স্যামিলটনের কাছে।
আচ্ছা! ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তমি ওঁর সাথে দেখা করব। যাক এসব কথা। এবার তোমার বিদ্রোহের কাহিনী শোনাও-একেবারে গোড়া তো-খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দেবে না।
ক্যাপ্টেম ব্রাইয়ের ভাষ্য আপনি শুনেছেন? আমাকে কি জঘন্য ভাবে চিত্রিত করা হয়েছে ওতে জানেন?
হ্যাঁ, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন তিনি। ব্লাই আমার বন্ধু। ওর চরিত্রের ভাল দিকগুলোর কথা যেমন জানি খারাপ দিকগুলোর কথাও তেমন জানি। ও একেবারে মন থেকে তোমাকে অপরাধী বলেছে। তা সত্ত্বেও আমি বলছি, আমি তোমাকে লিখ বলেই ভাবি।
উনি কি এখন ইংল্যান্ডে আছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না আবার ওকে তাহিতিতে পাঠানো হয়েছে। এই একই কাজে।
খবরটা শুনে দমে গেলাম আমি। কেন জানি না কিছুদিন ধরে আমার মনে হচ্ছিল, ওঁর সঙ্গে কথা বললে উনি আমার সম্পর্কে মত পাল্টাবেন; ক্রিশ্চিয়ানের সাথে সে রাতের আলাপটা যে সত্যি সত্যি বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র ছিল না তা উনি বুঝতে পারবেন। স্যার জোসেফকে বললাম সেকথা।
উনি বললেন, দেখ, ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। যতই ভাবো না কেন, তোমার বিচার শুরু হওয়ার আগে দেশে ফিরছে না ব্লাই। তোমার কাহিনী শোনাও, বুঝে দেখি কি ভাবে তোমাকে সাহায্য করা যায়।
ডা. হ্যামিলটনকে যেমন শুনিয়েছিলাম স্যার জোসেফকেও শোনালাম। আমাদের রওনা হওয়ার পর থেকে ধরা পড়া পর্যন্ত সব। শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন স্যার জোসেফ ব্যাঙ্কস।
বিয়্যাম, বাস্তব বাস্তবই, অবশেষে তিনি বললেন, যত কঠোরই হোক না কেন বুকে সাহস নিয়ে তার মুখোমুখি হওয়া ভাল। মহাবিপদে পড়ে গেছ তুমি। ব্লাইয়ের সাথে তুমি লঞ্চে যেতে চেয়েছিলে কথাটা যে জানত সেই মিস্টার লেনসন মারা গেছে; বিদ্রোহের আগের রাতে ক্রিশ্চিয়ান পালাতে চেয়েছিল, তুমি ছাড়া আর যে জানত সেই নর্টনও মারা গেছে।