বেলে চরাটায় নামলাম আমরা। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস নৌকার পাল এবং দাঁড় দিয়ে তাবু খাটানোর নির্দেশ দিল। এখানে দুদিন রইলাম আমরা। এর ভেতর নৌকাগুলোকে দীর্ঘ যাত্রার জন্যে তৈরি করে ফেলল ছুতোর মিস্ত্রীরা। আমরা যারা বন্দী তাদের সঙ্গে বন্দীর মত আচরণ করা হচ্ছে আগের মতই। চরায় নামার পর পরই চার জন মাস্কেটধারীকে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের। পাহারা দেয়ার জন্যে। জাহাজ থেকে নামানোর সময় তাড়াহুড়োর ভেতর যতখানি সম্ভব খাবার এবং পানীয় ওঠানো হয়েছিল নৌকাগুলোয়। এই দুদিনে তা থেকে এক কণাও খরচ করতে দিল না ক্যাপ্টেন। ক্ষুধা তৃষ্ণা যখন অসহ্য হয়ে উঠল শামুক ঝিনুক যা পেলাম সৈকতে কুড়িয়ে খেয়ে নিলাম। যারা সহ্য করতে পারল, না খেয়ে রইল। ডা. হ্যামিলটন তার ওষুধপত্রের বাক্সটা বাঁচাতে পেরেছেন। এজন্যে খুব খুশি তিনি। এক ফাঁকে আমাকে জানালেন, আমার পাণ্ডুলিপিগুলোও বাঁচাতে পেরেছেন।
অগাস্টের একত্রিশ তারিখ সকালে নৌকাগুলো পানিতে ভাসানো হলো আবার। ডাচ উপনিবেশ টিমোর-এর পথে রওনা হলাম আমরা।
অবর্ণনীয় দুঃখ আর কষ্ট ভোগ করে পনেরো সেপ্টেম্বর মাঝরাতে যখন আমরা টিমোর দ্বীপের কুপ্যাঙ-এ পৌঁছুলাম তখন আমাদের শরীরে হাড় আর চামড়া ছাড়া কিছু নেই। শরীর জুড়ে তৃষ্ণা। ক্ষুধার অনুভূতি লোপ পেয়েছে অনেক আগে।
পুরো উপনিবেশ তখন ঘুমিয়ে। রাতটা শান্ত। নক্ষত্র খচিত স্বচ্ছ আকাশ। কূলের যেখানে আমাদের নৌকা ঠেকেছে তার কাছেই নোঙ্গর করে আছে একটা জাহাজ আর দুতিনটে ছোট ছোট জলযান। তীরের সামান্য ওপাশে একটা দুর্গ। তার উঁচু প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে করুণ সুরে আর্তনাদ করছে একটা কুকুর। আর কোন শব্দ নেই চরাচরে। নৌকার যেখানে যে যেমন ভাবে ছিলাম ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সূর্য অনেকখানি উঠে আসার আগে সে ঘুম কারও ভাঙল না।
.
ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস আর তার সঙ্গীরা নিঃসন্দেহে উপভোগ করেছে কুপ্যাঙ এর দিনগুলো। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অতিথি হয়ে থেকেছে। বন্দীরাও আতিথেয়তা পেয়েছে, তবে একটু অন্য ধরনের। অবিলম্বে আমাদের দুর্গের মাটির নিচের একটা কুঠুরিতে নিয়ে আটকানো হলো।
কুপ্যাঙ-এ যতদিন ছিলাম তার ভেতর একরারের জন্যেও এডওয়ার্ডস আমাদের দেখতে আসেনি। তবে ডা, হ্যামিলটন আমাদের ভোলেননি। প্রথম সপ্তাহটা তিনি প্যানডোরার অসুস্থদের সেবায় ব্যয় করলেন-াদের বেশ কয়েকজন পৌঁছানোর কয়েক দিনের মধ্যেই মারা গেল। এরপর একটু অবসর পেতেই স্থানীয় ডাচ সার্জনকে সঙ্গে নিয়ে এলেন আমাদের দেখতে।
অক্টোবরের ছয় তারিখে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ রেমব্যাঙ-এ চাপলাম আমরা জাভা দ্বীপের বাতাভিয়ায় যাওয়ার জন্যে।
রেমব্যাঙ খুব পুরানো জাহাজ। খোলে অসংখ্য ফুটো। কাঠামোটাও নড়বড়ে। প্রথম দিন থেকেই অনবরত পানি সেঁচতে হলো তাকে ভাসিয়ে রাখার জন্যে। বলা বাহুল্য বন্দীদের দিয়েই করানো হলো কাজটা।
অক্টোবরের একত্রিশ তারিখে আমরা পৌঁছুলাম সামারাঙ-এ। এখানে থামার কথা না থাকলেও জাহাজ মেরামত করিয়ে নেয়ার জন্যে থামতে বাধ্য হলেন রেমব্যাঙ-এর ক্যাপ্টেন। কারণ শেষ দিকে পানি ওঠার পরিমাণ এত বেড়ে গিয়েছিল যে জাহাজের বেশির ভাগ নাবিককেই আমাদের সঙ্গে হাত লাগাতে হয়েছিল পানি সেঁচার কাজে।
সামারাঙ-এ পৌঁছে সবিস্ময়ে আমরা দেখলাম, মরিসনের স্কুনার রিজোল্যুশন অনেক আগেই সেখানে এসে বসে আছে। হারিয়ে যাওয়ার পর ওরাও খোঁজাখুঁজি করেছিল প্যানডোরাকে। না পেয়ে শেষে এখানে চলে এসেছে। অলিভার অর্থাৎ এডওয়ার্ডস যাকে রিজোল্যশন-এর দায়িত্ব দিয়েছিল সে জানত দেশে ফেরার পথে প্যানডোরা সামারাঙ-এ থামবে, তাই অন্য কোথাও না গিয়ে এখানেই এসেছে।
সামারাঙ-এ রিজোলশন বিক্রি করে দিল এডওয়ার্ডস। যে টাকা পুের তা ভাগ করে দিল প্যানডোরার নাবিকদের ভেতর পোশাক-আশাক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্যে। জাহাজটা যারা বানিয়েছিল তাদের এক শিলিংও দেয়া হলো না। টাকা না পেলেও অন্তত এই ভেবে ওরা সান্ত্বনা পেল যে, যে দক্ষতায় ওরা ছোট্ট স্কুনারটা তৈরি করেছিল তা ইংল্যান্ডের পেশাদার জাহাজ নির্মাতাদের চেয়ে কম নয় কোন অংশে।
রেমব্যাঙ-এর মেরামত শেষ হওয়ার পর আবার আমরা রওনা হলাম। নিরাপদেই পৌঁছুলাম বাতাভিয়ায়। এখানে চার ভাগে ভাগ হয়ে হল্যান্ড পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার জন্যে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চারটে জাহাজে উঠল প্যানডোরার নাবিকরা। লেফটেন্যান্ট পারকিন, মাস্টার, ভাণ্ডাররক্ষক, গোলন্দাজ, কেরানী, দুজন মিডশিপম্যান আর বাউন্টির দশ বন্দীকে নিয়ে ভিডেনবার্গ নামক জাহাজে উঠল ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস। বাকিরা অন্য তিন জাহাজে। সতেরোশো বিরানব্বই-এর পনেরো জানুয়ারি উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছুল ভিডেনবার্গ। এইচ.এম.এস গরগন তখন অপেক্ষা করছে সেখানে, শিগগিরই ইংল্যান্ডের পথে রওনা হবে। সদলে এডওয়ার্ডস ভিডেনবার্গ থেকে নেমে গরগনে উঠল।
প্রায় তিন মাস আমরা অন্তরীপে রইলাম। পুরো সময়টা অন্তরীণ থাকতে হলো গরগনে। জাহাজটার ক্যাপ্টেন মিস্টার গার্ডনার অভাবনীয় সদয় ব্যবহার করলেন,আমাদের সাথে। চার হাত-পায়ের বদলে শুধু এক পায়ে বেড়ি পরিয়ে বেঁধে রাখলেন। পুরানো একটী পাল ভাজ করে দিলেন রাতে শোয়ার জন্যে। একটানা বারো মাস যারা খালি মেঝেতে কাটিয়েছে তাদের কাছে রীতিমত্ব বিলাস মনে হলো ব্যাপারটা। জাহাজ যখন সাগরে ভাসল প্রতিদিন কয়েক ঘন্টা করে ডেকের খোলা হাওয়ায় কাটানোরও অনুমতি দিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন গার্ডনার। এসব দেখে মনে মনে জ্বললেও কিছু বলতে পারল না এডওয়ার্ডস, কারণ জাহাজটা তার নয়।