.
পনেরো
পরের পুরো দিনটা জাহাজের নৌকাগুলো ব্যস্ত থাকল ডাঙা থেকে তাজা খাবার আনার কাজে। পরদিন ভোরে নোঙ্গর তুলে পাল উড়িয়ে দিল হিজ ম্যাজেস্টিজ শিপ প্যানোরা।
বেশ কয়েক দিন কেটে যাওয়ার পর আমরা জানতে পারলাম, প্যানডোরা একা চলছে না, মরিসনের ছোট্ট স্কুনার রিজোল্যুশনকে সাথে নিয়ে চলেছে সে। প্যানডোরার মাস্টারের মেট মিস্টার অলিভারকে ওটার পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে এডওয়ার্ডস। সঙ্গে দিয়েছে একজন মিডশিপম্যান, একজন কোয়ার্টার মাস্টার আর ছজন খালাসী। প্যানডোরার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, এগিয়ে চলেছে ছোট্ট জাহাজটা!
পরের তিনটে মাসে তাহিতির চারপাশের কয়েকশো মাইল সমুদ্র চষে ফেলল.ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস। কিন্তু পাওয়া গেল না বাউন্টিকে। ক্রিশ্চিয়ান বা তার সঙ্গীদেরও কোন খোঁজ পাওয়া গেল না আশপাশের দ্বীপগুলোয় খবর নিয়ে। হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেন লোকগুলো।
এই খোঁজাখুঁজির ভেতর এক দুর্যোগময় রাতে হারিয়ে গেল রিজোল্যুশন। ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল সে রাতে। সামান্য ঝড়ও ছিল। এর ভেতর কখন যে কোনদিকে চলে গেল ওটা কেউ টের পায়নি। তিন চার দিন একটানা খুঁজেও আর তাকে পাওয়া গেল না। অবশেষে অগাস্টের দুতারিখে ইংল্যান্ডের পথে রওনা হলো প্যানোরা।
জেমস গুডের কাছে খবর পেলাম অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনির মাঝের এডেভার প্রণালীর দিকে এগোচ্ছি আমরা।
সপ্তাহ তিনেকের ভেতর গ্রেট ব্যারিয়ার রীফ-এর উত্তর অংশে পৌঁছে গেল প্যানডোরা। এখানে সাগর ভীষণ বিপজ্জনক। চারদিকে ডুবো আধা ডুবো পাহাড়ের ছড়াছড়ি। সেগুলোয় বাধা পেয়ে ভয়ঙ্কর গর্জনে ভেঙে পড়ছে ঢেউ। এমন সাগরে জাহাজ যদি ঝড়ের কবলে পড়ে তাইলে আর রক্ষা নেই। নির্ঘাত ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেতে হবে। তারপর কি হবে একমাত্র ভবিতব্যই জানে।
আমাদের কপাল খারাপ বলতে হবে, অগাস্টের আটাশ তারিখ ভোর থেকেই জঘন্য আচরণ শুরু করল আবহাওয়া। এই শান্ত এই অশান্ত; এই রোদ, কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার মেঘ; তারপর হয় বৃষ্টি নয় ঝড়, তারপর আবার রোদ। সারাদিন চলল এরকম। জাহাজ বাঁচাতে কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হলো নাবিকদের বদ্ধ ঘরে বসে তা না দেখতে পেলেও অনুভব করলাম ঠিকই।
দিনটা তো কোন মতে গেল, সন্ধ্যার পরেই ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে নেমে এল দুর্ভোগ। ঝড় উঠল আচমকা। তারপরই ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেলো প্যানডোরার তলা। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে। শিকল বাঁধা হাত আর পায়ে টান পড়ল ভয়ানক। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলাম সবাই। কোন মতে সামলে উঠে বসতে না বসতেই আবার। এবার আগের চেয়ে জোরে। আটকে গেছে জাহাজ।
যেমন এসেছিল তেমনি আচমকা থেমে গেল ঝড়। একটু পরে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস-এর চিৎকার শুনতে পেলাম: কি অবস্থা, মিস্টার রবার্টস?
ভাল না, স্যার! নিচ থেকে ভেসে এল রবার্টস-এর গলা। ভীষণ জোরে পানি উঠছে। এর মধ্যেই তিন ফুট জমে গেছে খোলে!
তক্ষুণি অনবরত পানি সেঁচার নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন। আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার দমকা হাওয়া। এবার আরও জোরে। মড় মড় করে উঠল প্যানডোরার কাঠামো। মৃদু একটা ধাক্কার মত অনুভব করলাম। ডেকের ওপর থেকে কেউ একজন চিৎকার করল: ছুটে গেছে, স্যার!
হ্যাঁ; দুলুনি টের পাচ্ছি। ডুবো পাহাড় থেকে মুক্ত হয়েছে জাহাজ। ভোর পর্যন্ত আর কোন দুর্ঘটনা ঘটল না। কিন্তু দিনের প্রথম আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আবার ধাক্কা খেলো প্যানডোরা। একটু পরেই সমবেত কণ্ঠের আতঙ্কিত চিৎকার উঠল জাহাজ জুড়ে। বুঝলাম, ডুবছে প্যানডোরা। আতঙ্ক ভর করল আমাদের:মধ্যেও। এখনই যদি মুক্ত না করে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ইঁদুরের মত ডুবে মরব। মুসভ্যাট, বারকিট, হিব্রান্ডট কেঁদে উঠল হাউমাউ করে। একটু পরেই প্যানডোরার মাস্টার অ্যাট আর্মসকে চাবি হাতে কারা-কুঠুরিতে ঢুকতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমরা।
বাইরে রেরিয়ে দেখি সবগুলো নৌকা নামানো হয়ে গেছে পানিতে। নাবিকদের অনেকে উঠে পড়েছে তাতে জাহাজ থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিয়ে গেছে তারা নৌকাগুলোকে, যেন জাহাজের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ডুবে না যায়, বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সাগর এখনও অশান্ত, ঝড় চলছে। প্যানডোরার ডুবতে আর কয়েক মিনিটও লাগবে কিনা সন্দেহ। পানি পৌঁছে গেছে ওপরের। ডেক পর্যন্ত। আমরাও ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লাম সাগরে। শিকল খুলে নেয়া হলেও হাতকড়াগুলো খুলে দেয়া হয়নি। সেজন্যে সাঁতার কাটতে খুব কষ্ট হলো যদিও তবু শেষ পর্যন্ত একটা নৌকায় পৌঁছুতে পারলাম আমি। পেছনে ফিরে তাকানোর অবসর যখন পেলাম তখন আর প্যানডোরা নেই জলের ওপর। মাস্তুলের মাথাগুলো কেরল জেগে আছে তখনও। সেগুলো তলিয়ে গেল একটু পরেই।
তারপর আকাশ আবার পরিষ্কার, সাগর শান্ত। সূর্য বেরিয়ে এল মেঘের আড়াল থেকে। ছোট একটা বেলে চরার কাছে জড়ো হলো সবগুলো নৌকা। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস-এর নির্দেশে বেঁচে যাওয়া, লোকদের হিসেব নিতে গিয়ে দেখা গেল প্যানডোরার তিন জন নাবিক আর চারজন বন্দী মারা গেছে পানিতে ডুবে। বন্দী চারজন হলো: স্টুয়ার্ট, সামনার, হিব্রান্ডট আর স্কিনার।
মরিসন আমাকে বলল, স্টুয়ার্টকে ও দেখেছে ডুবে যেতে। জাহাজটা যখন তলিয়ে যায় তখনও সে লাফ দিতে পারেনি। লাফ দেওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে, এই সময় ভারী একটা কাঠের টুকরো পানির নিচে থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে আঘাত করে ওর থুতনিতে। এক মুহূর্ত পরেই ও তলিয়ে যায় সাগরে। শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল আমার। তেহানি আর হেলেনকে ছেড়ে আসার সময় যেমন হয়েছিল অনেকটা তৈমন।