নরম্যান আর আমি খুশিতে প্রায় নেচে উঠেছিলাম ইংরেজ উর্দী দেখে, বলে চলল মরিসন। কিন্তু, অন্যদের কথা ভাবতেই সে খুশি আমাদের মিইয়ে গেল। ওদের সাবধান করার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু সম্ভব হয়নি, তার আগেই ধরা পড়ে গেলাম।
সেদিনই সন্ধ্যায় অন্যদেরও নিয়ে আসা হলো পাপারা থেকে। সাতজন ওা-ম্যাকইন্টশ, হিব্রান্ডট, বারকিট, মিলওয়ার্ড, সামনার, মুসভ্যাট আর প্রায়ান্ধ বায়ার্ন। কাল যে কারাকক্ষ মনে হয়েছিল বড়, সেটা আর বড় রইল না।
.
মের প্রথম দিকে এক সকালে আমাকে আর স্টুয়ার্টকে পায়ের বাঁধন খুলে বের করে আনা হলো কারা প্রকোষ্ঠ থেকে। নিচের ডেকের যে কেবিনটাকে সিক বে হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। দরজার সামনে দেখলাম ড়া, হ্যামিলটন অপেক্ষা করছেন। কোন কথা না বলে ভেতরে ঢোকার ইশারা করলেন আমাদের। ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর কি আশ্চর্য!-তেহানি আর পেগি বসে আছে। তেহানির কোলে আমাদের হেলেন, পেগির কোলে ওদের মেয়ে।।
সোজা আমার কাছে এসে দাঁড়াল তেহানি। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল:
শোনো, বিয়্যাম, কান্নাকাটি করার মত সময় আমার নেই। যা বলার তাড়াতাড়ি বলতে হবে। আতুয়ানুই এখন মাতাভাইয়ে। টাউতিরা থেকে তিনশো বাছাই করা যোদ্ধা সাথে নিয়ে এসেছে। ওরা দুভাগে ভাগ হয়ে উপকূলের দুদিকে অপেক্ষা করছে। অনেক দিন ধরে তোমার সাথে দেখা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু সম্ভব হয়নি। অবশেষে ডাক্তারের চেষ্টায় সুযোগ পেয়েছি। আতুয়ানুই বাতের বেলা জাহাজ আক্রমণ করতে চায়। অন্ধকারে কামান দেগে আমাদের কোন ক্ষতি ওরা করতে পারবে না। আমাদের যেটা ভয়, জাহাজ দখল করার আগেই না তোমাদের মেরে ফেলে সৈন্যরা। ডেকের ওপর যে ঘরটা তৈরি করেছে ওতে তোমাদের রেখেছে, তাই না? শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে? কি ভাবে তোমাদের পাহারা দেয় ওরা জানতে চায় আতুয়ানুই।
তেহানি আর ছোট্ট হেলেনকে দেখে খুশিতে এমন আত্মহারা হয়ে উঠেছি যে কিছুক্ষণ আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। হেলেনকে দুহাতে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম বুকের সঙ্গে।
বলো, বিয়্যাম, তাড়াতাড়ি, তাড়া দিল তেহানি। বেশি কথা বলার সময় আমরা পাব না।
কবে তুমি মাতাভাই-এ এসেছ, তেহানি?
তুমি টাউতিরা থেকে আসার তিন দিন পর। ভেবেছিলে তোমাকে আমি ভুলে যাব? আতুয়ানুই আর আমি-দুজনে মিলে এই পরিকল্পনা করেছি। তোমার সব বন্ধু আমাদের সঙ্গে আছে। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে আক্রমণ করার জন্যে।
আমাদের উদ্ধার করার কোন উপায় নেই, তেহানি, আমি বললাম, আতুয়ানুইকে বুঝিয়ে বোলো কথাটা। ও আর ওর লোকরা সব মারা পড়বে খামোকা।
না, না, বিয়্যাম! ওরা গুলি চালানোর আগেই আমরা ওদের লাঠিপেটা করে মেরে ফেলব। আতুয়ানুই কাল রাতেই আক্রমণ করতে চায়। কাল চাঁদ থাকবে না।
কেন আমাদের আটকে রাখা হয়েছে তেহানির কাছে তা ব্যাখ্যা করা অর্থহীন। ও কিছু বুঝবে না। যা-ও বা বোঝার সম্ভাবনা ছিল আমরাই তার গোড়া কেটে রেখেছি বিদ্রোহের ব্যাপারটা ওদের কাছে গোপন রেখে। ক্রিশ্চিয়ানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু জানাব না ইন্ডিয়ানদের। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি আমরা। কিন্তু এখন কি করে তেহানিকে বোঝাই ও আর আতুয়ানুই যে পরিকল্পনা করেছে তা পাগলামি?
ক্যাপ্টেন এটুয়াটি (এডওয়ার্ডস) হিটিহিটিকে বলেছে, বলে চলল তেহানি, তোমরা নাকি খারাপ লোক। তোমাদের ধরেছে ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দেবে বলে। হিটিহিটি বিশ্বাস করে না এসব আজেবাজে কথা। কেউই বিশ্বাস করে না।
তেহানি আমাকে যা যা বলেছে ইতিমধ্যে পেগিও স্টুয়ার্টকে সে সব বলেছে। দেখে বুঝলাম আমার মত কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা স্টুয়ার্টেরও। দুজনই চুপ করে আছি।
কই, বিয়্যাম, বলো! তাড়া লাগাল তেহানি।
হ্যাঁ বলো! ওকে সমর্থন করল পেগি।
দেখ, তেহানি, তোমরা যা ভাবছ, তা অসম্ভব, এক কথায় পাগলামি, অবশেষে আমি বললাম। জাহাজ যদি দখল করতেও পারো আমাদের বাঁচাতে পারবে না। আমাদের হাত-পা সব সময় শিকল দিয়ে বাঁধা থাকে। বন্দুক হাতে পাহারাদার দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দিন রাত। তোমরা জাহাজে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওরা আমাদের খুন করবে।
নিঃশব্দে আসব আমরা–শুরু করল তেহানি।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, তাতে লাভ হবে না। তোমরা যে হামলা চালাতে পারো আগে থাকতেই আন্দাজ করেছে ক্যাপ্টেন এটুয়াটি, (কথাটা সত্যি) তাই দিনরাত তীরের দিকে চোখ রাখার জন্যে কয়েক জনকে ডেকের ওপর রেখেছে সে।
এতক্ষণ কোন মতে স্থির ছিল তেহানি আর পেগি। এর পর আর পারল না। কিছুই করার নেই বুঝতে পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল পেগি। স্টুয়ার্ট বৃথাই চেষ্টা করল ওকে শান্ত করার। তেহানি কাঁদল না। একটা শব্দও করল না। ধীরে ধীরে শুধু বসে পড়ল মেঝেতে আমার পায়ের কাছে। মুখটা দুহাতে ঢাকা। পেগির মত ও-ও যদি কাঁদত আমার জন্যে অনেক সহজ হত কষ্ট সহ্য করা। আমার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ওর পাশে ঘটু গেড়ে বসলাম। কিন্তু, সান্ত্বনা দেয়ার মত কোন কথা খুঁজে পেলাম না।
একটু পরেই দরজা খুলে গেল। ডা. হামিলটন ঢুকলেন, পেছনে রক্ষীরা। পেগি এবার হু-হুঁ করে কেঁদে ফেলল স্টুয়ার্টকে জড়িয়ে ধরে! রীতিমত টানা হ্যাঁচড়া করতে হলো ওকে ছাড়ানোর জন্যে। বাচ্চাকে এক হাতে ধরে অন্য হাতে তেহানিকে ওঠালাম আমি। এক মুহূর্ত আমাকে জড়িয়ে ধরে বুইল ও। তারপর পেগির হাত ধরে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে। বাচ্চা কোলে ওদের পেছন পেছন এগোলাম আমি আর স্টুয়ার্ট। গ্যাংওয়ের কাছে গিয়ে ভত্যদের হাতে তুলে দিলাম বাচ্চা দুটোকে। ওরা নেমে গেল ক্যানোয়। স্টুয়ার্ট তক্ষুণি ওকে কারাকক্ষে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করল। ওর অনুরোধ রাখল রক্ষীরা। আর আমাকে নিজের কেবিনে নিয়ে গেলেন ডা. হ্যামিলটন। জানালা দিয়ে দেখলাম, ধীরে ধীরে জাহাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্যানোটা। দাঁড় বাইছে তুয়াহু, টিপাউ, আর পেগির বাবা। তেহানি আর পেগি বসে আছে ক্যানোর সামনের দিকে। এক দাসীর কোলে ওর বাচ্চা। আমার হেলেন তার মায়ের কোলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম, ক্যানোটা ছোট হতে হতে অস্পষ্ট হয়ে গেল। তারপর এক সময় হারিয়ে গেল তীরের কাছে জটলা করে থাকা অনেক ক্যানোর ভীড়ে।