রাতারাতি বীর হয়ে উঠলেন ব্লাই, বলে চললেন ডা. হ্যামিলটন। হবেন-ই বা কেন?-আমাদের নৌযাত্রার ইতিহাসে এমন খোলা নৌকায় সাগর পাড়ি দেয়ার কথা কেউ কোনদিন শোনেনি। সারাদেশ ব্লাইয়ের প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। সেটাই স্বাভাবিক, তাই না?-আর যারা বাউন্টিতে থেকে গিয়েছিল তাদের চিহ্নিত করা হলো জঘন্য অপরাধী হিসেবে।
কিন্তু, স্যার, বাউন্টিতে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের অনেকে যে বাধ্য হয়েছিল থাকতে, তা মিস্টার ব্লাই বলেননি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না। ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডসকে যে নির্দেশপত্র অ্যাডমিরালটি দিয়েছে আমি সেটা পড়েছি। বাউন্টিতে যারা থেকে গিয়েছিল তাদের নামের একটা তালিকা আছে ওতে। বলা হয়েছে, তোমাদের সবাইকে বিদ্রোহী হিসেবে গণ্য করতে হবে।
তার মানে কি ইংল্যান্ডে না পৌঁছা পর্যন্ত যেখানে আছি সেখানেই থাকতে হবে আমাদের?
ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে এডওয়ার্ডস-এর ইচ্ছার ওপর। তবে আমি চেষ্টা করব তোমাদের যেন একটু ভাল কোন জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়।
একটা কথা, স্যার, যদি সম্ভব হয় ওকে একটু বলবেন যেন আমাদের কথা বলতে দেন নিজেদের ভেতর।
মানে! তোমাদের কথা বলতে দেয় না নাকি?
না, স্যার।
ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না, আমি বলব। এবার আসল কথায় আসি আবার তোমার পাণ্ডুলিপিটা নিশ্চয়ই তোমার বাড়িতে?
হ্যাঁ। আমার বন্ধু এবং শ্যালক তুয়াহুকে আমার নাম করে বললে আমার সিন্দুকটা ও জাহাজে পৌঁছে দিয়ে যাবে।
এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন ডা. হ্যামিলটন। নামটা লিখে দাও। আমি ওকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলব। স্যার জোসেফ বার বার আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তোমার পাণ্ডুলিপিটা যেন কোন ভাবেই নষ্ট না হয়।
ঘড়ির দিকে তাকালেন সার্জন।
এবার তোমাকে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে, বলে তিনি উঠে গিয়ে দরজা খুলে কেবিনের বাইরে এপাশ ওপাশ দেখলেন একবার। তারপর আবার দরজা বন্ধ করে বললেন, স্যার জোসেফ আরেকটা দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে। বলেছেন, তোমাকে যদি খুঁজে পাই, এই চিঠিটা যেন দেই তোমাকে।
হাত বাড়িয়ে নিলাম চিঠিটা। খাম খুলে হাতের লেখা দেখেই কেঁপে উঠল শরীর। মা লিখেছেন। মোটামুটি দীর্ঘ চিঠি, কিন্তু বক্তব্য মূলত একটাই; আমি যে নিরপরাধ তাতে কোন সন্দেহ নেই তার মনে। এখন তার একমাত্র চিন্তা, ধরা পড়ার পর বন্দী অবস্থায় দেশে ফেরার যে কষ্ট তা সইতে পারব তো? সব শেষে ধৈর্য ধরে মন প্রাণ দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকার পরামর্শ দিয়ে শেষ করেছেন মা।
.
ঠিকই অনুমান করেছিলেন মা। এর পরের কয়েকটা মাসের কাহিনী অমানুষিক কষ্ট আর দুঃখ ভোগের কাহিনী। আমাদের যতভাবে সম্ভব কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করল প্যানডোরার ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস আর তার দুই সহকারী লেফটেন্যান্ট পার্কিন এবং সেই কর্পোরাল। কি করে যে সে কষ্ট সহ্য করে ইংল্যান্ডে পৌঁছেছি, ভেবে এখন অবাক হই।
ডা. হ্যামিলটনের অনুরোধে অবশ্য আমাদের একে অন্যের সাথে আলাপ করার অনুমতি দিয়েছে ক্যাপ্টেন, তবে কথা বলতে হবে শুধু ইংরেজিতে। ইন্ডিয়ান ভাষায় যদি একটা শব্দও উচ্চারণ করি সুবিধাটুকু কেড়ে নেয়ার ভয় দেখিয়েছে সে।
কয়েকদিন পর নিজ চোখে আমাদের অবস্থা দেখতে এসে এডওয়ার্ডস এর মনে হলো আমাদের হাত পায়ের বেড়িগুলো যথেষ্ট মজবুত নয়। সেদিনই বেড়িগুলো বদলে দেয়া হলো। আগের বেড়িগুলো একটু ঢিলে ঢালা ছিল; এবারেরগুলো হলো অনেক আঁটো। হাতের মাংস কেটে বসল প্রায়। আরও কয়েকদিন পর এক সকালে ডেকের ওপর শুরু হলো ঠাস ঠাস শব্দ। আমাদের খাবার দিতে আসে যে নাবিকটা তার নাম জেমস গুড। ডা. হ্যামিলটন ছাড়া প্যানডোরার এই একটা লোকের কাছে আমরা একটু সদয় ব্যবহার পাই। কেন যে লোকটার মনে আমাদের সম্পর্কে সহানুভূতি জেগেছে। জানি না। সে সেদিন দুপুরের খাবার দিতে এসে জানাল, ডেকের ওপর আমাদের থাকার জন্যে নতুন ঘর তৈরি হচ্ছে। ডা. হ্যামিলটনের পীড়াপীড়িতেই নাকি এটা করা হচ্ছে।
পরদিন রিকেল নাগাদ শেষ হলো ঘর তৈরির কাজ। সন্ধ্যার সময় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে। এর পর আর যে কদিন প্যানডোরায় রইলাম এই নতুন কারাকক্ষে কাটলো। নিচের কুঠুরির চেয়ে কোনু, অংশে উন্নত নয় এটা, একটু বড় এই যা। বড় কেন, বুঝলাম দুদিন পরেই যখন মরিসন, নরম্যান আর এলিসনকে এনে বেঁধে রাখা হলো আমাদের পাশে। আরও একটা ব্যাপার বুঝলাম, আমরা ধরা পড়ার পর এত দিনেও প্যানডোরা রওনা হয়নি কেন। কারণ একটাই, বাউন্টির বাকি নাবিকদের ধরার জন্যে অপেক্ষা করছে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডস।
মরিসনের কাছে শুনলাম ওদের কাহিনী। তাহিতিরই অন্য এক অংশে থাকত ম্যাকইন্টশ, হিলব্রান্ডট আর মিলওয়ার্ড। জায়গাটার নাম পাপারা। মরিসন ওদের স্কুনার-যার নাম দিয়েছে ওরা. রিজোল্যুশন-নিয়ে গিয়েছিল। পাপারায় ওই তিনজনকে তুলে নেয়ার জন্যে। ওখানে পৌঁছে আবহাওয়া ভাল দেখে অতিরিক্ত কিছু শুয়োরের মাংস নুন দিয়ে নেয়ার কথা ভাবে ওরা। এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে। বেশ কয়েকটা দিন লেগে যায় একাজে। অবশেষে ওরা যখন আবার রওনা হওয়ার জন্যে মোটামুটি তৈরি এই সময় জানতে পারে মাতাতাইয়ে প্যানডোরার আসার খবর। ভেবে চিন্তে কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগেই নৌ-সেনা বোঝাই একটা লঞ্চ এসে দখল করে নেয় রিজৌলুশন।